প্রথম
পাতা
আলোচনা
গোয়েন্দা
ও রহস্য কাহিনীর লেখক, বই, গোয়েন্দা ....
গল্প
উপন্যাস
আন্তর্জাতিক
|
নীল বসনা
সুন্দরী
তৃতীয়
খণ্ড
নিয়তি - রহস্যময়ী
Mme-de
Mon [aside], A clue-another clue-that I
will follow,
Until it lead to the throne?
Lord Lytton- The Duchess de la Vulliere. Act
III, Scene III.
প্রথম
পরিচ্ছেদ
আর এক উদ্যম
দেবেন্দ্রবিজয়
বাটীতে পৌঁছিয়া বস্ত্রাদি পরিবর্ত্তন করিলেন। তখনই
ডাক্তারের কাছে খবর গেল। ডাক্তার আসিয়া তাঁহার মস্তকের
ক্ষতস্থান বাঁধিয়া দিয়া গেলেন।
অপরাহ্নে দেবেন্দ্রবিজয় শ্রীশচন্দ্রকে নিকটে ডাকিলেন।
তিনি লতিমন বাইজীর বাটীতে যে ছুরিখানি পাইয়াছিলেন
আল্মারীর ভিতর হইতে সেই ছুরিখানি বাহির করিয়া বলিলেন,
"আমার হাতে এটা দেখিতে পাইতেছ?"
শ্রীশচন্দ্র মাথাটা একপার্শ্বে খুব অবনত করিয়া মনোভাব
প্রকাশ করিল-মুখে কিছু বলিল না।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিতে লাগিলেন, " তোমাকে এবার
একটা বড় শক্ত কাজ করিতে হইবে। কল্যকার সেই মজিদের
কথা তোমার খুব মনে আছে বোধ করি।
সেই ভদ্রলোকের বাড়ীতে ঠিক এই রকম আর একখানি ছুরি আছে;
যে কোন প্রকারে সেই ছুরিখানি বাহির করিয়া আনিতে হইবে।
পারিবে?"
শ্রীশচন্দ্রের ওষ্ঠাধর কুঞ্চিত হইল। মুখে একবার গভীর
চিন্তার রেখা ফুটিয়া উঠিল। ক্ষণপরে পাকা বুদ্ধিমানের
ন্যায় মস্তক সঞ্চালনপূর্ব্বক বলিল, "খুব পারিব?"
নবীন গোয়েন্দা শ্রীশচন্দ্র কিরূপ কৌশলে কার্যে্যাদ্ধার
করিবে, ঠিক করিতে না পারিয়া, প্রবীন দেবেন্দ্রবিজয়
সবিস্ময়ে শ্রীশের মুখের দিকে চাহিলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন,
"কিরূপে?"
শ্রীশ বলিল,"যেরূপে পারি। যদি ছুরিখানি মজিদ
খাঁর বাড়ীতে থাকে, আমি নিশ্চয়ই সন্ধান ক'রে বাহির
করিব। ত' যদি না পারি, তবে এতদিন আপনার কাছে প'ড়ে
আছি কেন? আজ সন্ধ্যার পর মুসলমান ছেলেদের মত কাপড়-চোপড়
প'রে, তার দরজায় হত্যা দিয়ে পড়ব-মড়ার মত প'ড়ে থাক্ব।
যেন না খেতে পেয়ে মরতে বসেছি, ঠিক এমন ভাব দেখাব।
অবশ্যই ছেলে-মানুষ দেখে ,মজিদ আমাকে কিছু খেতে দিবার
জন্য বাড়ীর ভতরে নিয়ে যাবে। একবার বাড়ীর ভিতরে যেতে
পারলে শর্ম্মারামকে আর পায় কে-কাজ না শেষ ক'রে, শর্ম্মারাম
সে বাড়ী থেকে সহজে বেরুবে না।"
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, "যেরূপে পার, কার্য্যোদ্ধার
করা চাই। খুব সবধান, ছুরিখানা যদি পাওয়া যায়, খুব
সবধানে রাখিবে; বিষাক্ত ছুরি-একটুখানি কাটিয়া গেলে
আর রক্ষা নাই-মনে থাকে যেন।"
শ্রীশচন্দ্র বলিল, "খুব মনে থাকিবে।"
দ্বিতীয়
পরিচ্ছেদ
উদ্যমের ফল
সন্ধ্যা
উত্তীর্ণ গিয়াছে। আকাশে মেঘ, তন্নিম্নে অন্ধকার, মেঘও
অন্ধকার যন একসঙ্গে মিশিয়াছে। মেঘে সনাথনক্ষত্রমালা
ঢাকা পড়িয়াছে। এবং অন্ধকারে গগনতলস্পর্শী বড় বড় গাছগুলা
প্রকাণ্ড দৈত্যের ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে।
এমন সময়ে শ্রীশচন্দ্র দীন মুসলমান বালকের বেশে বাটী
হইতে বাহির হইল। একেবারে সরাসরি মজিদের বাড়ীর সম্মুখে
গিয়া উপস্থিত হইল। গোপনে খবর লইল, মজিদ খাঁ বাড়ীতে
নাই-সান্ধ্য-ভ্রমণে বাহির হইয়াছেন। শ্রীশচন্দ্র মনে
মনে বুঝিল, খাঁ সাহেব তাহা হইলে এখনই ফিরিবেন। দ্বার
সম্মুখস্থ সোপানের উপরে তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়িল।
অনতিবিলম্বে মুষলধারে ভয়ানক বৃষ্টি আরম্ভ হইল। মেঘের
গর্জ্জনে দিগবলয় পর্য্যন্ত কম্পিত হইতে লাগিল। এবং
ঘন ঘন ক্ষণপ্রভার তীব্র দীপ্তিতে বিরাট বিশ্ব আলোকিত
হইতে লাগিল। ইহাতে শ্রীশচন্দ্র সুবিধা বোধ করিল; সেইখানে
শুইয়া পড়িয়া বৃষ্টিজলে ভিজিতে লাগিল এবং কাঁপিতে লাগিল।
পথে লোকের গতিবিধি নাই বলিলেই হয়; কদাচিৎ কোন পথিক
ছাতা মাথায় দিয়া দ্রুতবেগে বাটী ফিরিতেছে; কদাচিৎ
কোন ইতর শ্রমজীবী কর্ম্মস্থান হইতে বাটী ফিরিতেছে-ভিজিতে
ভিজিতে, গায়িতে গায়িতে চলিয়াছে। শ্রীশচন্দ্রকে লক্ষ্য
করিবার কাহারও অবসর নাই। পথে প্রায় এক হাঁটু জল জমিয়া
গিয়াছে। কিয়ৎপরে শ্রীশচন্দ্র একটা শব্দ শুনিতে পাইল;
বোধ হইল কে একটা লোক ছপ্ ছপ্ শব্দে জল ভাঙিয়া তাহারই
দিকে আসিতেছে। যে হউক না কেন, মজিদ খাঁ আসিতেছেন,
মনে করিয়া শ্রীশচন্দ্র গেঙাইতে লাগিল-কাঁপিতে লাগিল।
পদশব্দে বুঝিতে পারিল, লোকটা তাহারই দিকে আসিতেছে।
শ্রীশচন্দ্র একবার বক্রদৃষ্টিপাতে বিদ্যুতের আলোকে
দেখিয়া লইল, তাহার অনুমান মিথ্যা নহে-মজিদ খাঁ বটে।
মজিদ অন্ধকারে আর একটু হইলেই শ্রীশচন্দ্রের ঘাড়ের
উপরে পা তুলিয়া দিতেন। গেঙানি শব্দ শুনিয়া তিনি চমকিত
চিত্তে একপার্শ্বে সরিয়া দাঁড়াইলেন। মজিদ খাঁ হউন
আর যিনিই হউন, কাহারও পা তাহার ঘাড়ের উপরে পড়িয়া বেদনা
প্রদান করে, এইরূপ ইচ্ছা শ্রীশচন্দ্রের আদৌ ছিল না,
সুতরাং মজিদ নিকটস্থ হইলে, সে একটু জোরে জোরে গেঙাইতে
আরম্ভ করিয়া দিল। মজিদ সবিস্ময়ে বলিলেন, "কেরে
তুই, এখানে?"
শ্রীশচন্দ্র পড়িয়া পড়িয়া গেঙাইতে লাগিল-উত্তর করিল
না; বরং এবার একটু মাত্রা চড়াইয়া দিল।
মজিদ বলিলেন, "কে তুই? এমন করছিস্ কেন, কি হয়েছে?"
শ্রীশচন্দ্র গেঙাইতে গেঙাইতে কহিল, "আ-মি-এ-সমা-ইল,
আজ-দু-দিন-খাও-য়া-হয়-নি।" পেটে হাত বুলাইতে এবং
গেঙাইতে লাগিল। তাহা দেখিয়া মজিদের হৃদয় দয়া নামক
কোন অদৃশ্য স্নৈহিক পদার্থ আর্দ্রীভূত হইল। তিনি অবনত
হইয়া ছদ্মবেশী শ্রীশের গাত্রে হস্তার্পণ করিয়া কহিলেন,
"অসুখ করেছে না কি, কি অসুখ করছে?"
শ্রীশচন্দ্র নিজের ক্ষুদ্র উদরে হস্তাবমর্ষণ করিতে
করিতে বলিল, "যত অসুখ-এই পেটের-ভ-ত-রে। আজ-দু-দিন-খেতে-পাই-নি।
পেট-জ্ব'-লে-গে-ল।"
মজিদের মন করুণাপূর্ণ। তিনি সেই অজাতশ্মত্রু বালকের
ধূর্ত্ততা বুঝিতে পারিলেন না। তাঁহার বোধ হইল, সত্যসত্যই
বালকের অত্যন্ত কষ্টভোগ হইতেছে। তিনি শ্রীশচন্দ্রকে
নিজের গৃহমধ্যে লইতে ব্যস্ত হইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন,
"তুমি উঠিতে পারিবে? এখানে পড়িয়া থাকিলে মারা
পড়িবে। আমি তোমাকে খাইতে দিব। ওঠ দেখি।" বলিয়া
তিনি শ্রীশের হাত ধরিয়া উঠাইবার চেষ্টা করিলেন।
বুদ্ধিমান শ্রীশ নানারূপে নিজের যন্ত্রণা ও দৌর্ব্বল্য
প্রকাশ করিয়া-টলিয়া-হেলিয়া-বসিয়া-অনেক রকম ভঙ্গি করিয়া
টলিতে টলিতে উঠিল। মজিদ অনেক কষ্টে তাহাকে সোপান অতিক্রম
করিয়া দ্বিতলে নিজের ঘরে লইয়া গেলেন। শ্রীশচন্দ্র
অবসন্নভাবে সেই গৃহতলে পুনরায় শুইয়া পড়িল-পড়িয়া ভয়ানক
কাঁপিতে আরম্ভ করিয়া দিল। এবং বাইন্ মৎস্যের মত ঘন
ঘন পাক্ খাইতে লাগিল। কেবল গেঙানিটা একটু কম পড়িল।
মজিদ দীপ জ্বালিয়া বলিলেন, "ভয় নাই, আমি এখনই
গরম দুধ লইয়া আসিতেছি।" বলিয়া ব্যস্তভাবে নীচে
নামিয়া গেলেন।
মজিদ চলিয়া যাইবামাত্র শ্রীশ একবার ঘরের চারিদিক্টা
দেখিয়া লইল। দেখিল, কেহ কোথায় নাই, ঘর আলোকিত-একেবারে
লাফাইয়া দাঁড়াইয়া উঠিল।
গৃহ-প্রাচীরের পার্শ্বে একটা আল্মারী ছিল, শ্রীশ তাহা
টানিয়া খুলিয়া ফেলিল। দীপবর্ত্তিকা হস্তে তাড়াতাড়ি
চারিদিক্ বেশ করিয়া দেখিয়া লইল। তন্মধ্যে ছুরি পাওয়া
গেল না।
গবাক্ষের নিকটে একখানি টেবিল ছিল। শ্রীশ ছুটিয়া সেই
টেবিলের নিকটে গেল; এবং টেবিলের উভয় পার্শ্বস্থ ড্রয়ার
দুইটিই একেবারে দুই হাতে টানিয়া খুলিয়া ফেলিল; তাহার
ভিতরে যে সব কাগজ-পত্র ছিল, তাহা উল্টাইয়া দেখিল-ছুরি
নাই।
একপার্শ্বে একটি ক্ষুদ্র বিছানা ছিল। শ্রীশ সেই বিছানার
গদি, বালিশ, লেপ সমুদয় তুলিয়া তুলিয়া দেখিল, সেখানেও
ছুরি পাওয়া গেল না। এত পরিশ্রম সার্থক হইল না-শ্রীশ
বড় হতাশ হইয়া পড়িল; কিন্তু হতাশ হইয়া বসিয়া থাকিবার
এ সময় নহে-আর এক মুহূর্ত্ত ভাবিবার সময় নাই-এখনই মজিদ
আসিয়া পড়িবেন। তিনি আসিয়া পড়িলে আর কিছুই হইবে না-সকল
শ্রম পণ্ড হইবে। এত জলে ভেজা-এত গেঙানি-এত কাঁপুনি
সকলই বৃথা হইবে। এমন কি প্রতিপালক দেবেন্দ্রবিজয়ের
নিকটে মুখ দেখানই ভার হইবে। শ্রীশচন্দ্র ব্যাকুলভাবে
গৃহের চারিদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করিতে লাগিল। টেবিলের
উপরে একটা কাঠের বাক্স ছিল। সেই বাক্সের উপরে শ্রীশের
দৃষ্টি পড়িল। শ্রীশ বাক্স খুলিতে গেল, খুলিতে পারিল
না-তাহা চাবিবন্ধ। বাক্সটা কৌশলে খুলিবার সময় ইহা
নহে-ভাঙিতে গেলেও বিলম্ব হইবে-ততক্ষণে মজিদ আসিয়া
পড়িবেন। শ্রীশ মনে ভাবিল, যখন ছুরি ঘরের আর কোথাও
পাওয়া গেল না; তখন নিশ্চয়ই তাহা এই বাক্সের ভিতরে
আছে; কিন্তু বাক্সটি চাবিবন্ধ, শ্রীশের বড় আশায় ছাই
পড়িল! শ্রীশ একবার মনে করিল, বাক্সটি তুলিয়া লইয়া
জানালা দিয়া পার্শ্বের গলিপথে ফেলিয়া দেবে-তাহার পর
সময় মত খুলিয়া দেখিতে পারিবে। যেমন সঙ্কল্প-তেমনই
কাজ-শ্রীশ দুই হাতে বাক্সটি লইয়া একটা উন্মুক্ত গবাক্ষের
দিকে অগ্রসর হইল। এমন সময়ে গবাক্ষ পার্শ্ববর্ত্তী
একখানি ছবির দিকে সহসা তাহার নজর পড়িল। শ্রীশ দেখিল,
সেই ছবির পার্শ্বে ছুরির অগ্রভাগের মত কি একটা দেখা
যাইতেছে; বাক্স রাখিয়া শ্রীশ তখনই সেটা আগে টানিয়া
বাহির করিল-একখানা ছুরিই বটে-ঠিক সেই রকমের ছুরি-ঠিক
এই রকমের একখানা ছুরি সে পূর্ব্বে দেবেন্দ্রবিজয়ের
হাতে দেখিয়া আসিয়াছে; কিন্তু ইহার বাঁট নাই-তা' না
থাক্। শ্রীশ তাড়াতাড়ি সেই বাক্সটি যথাস্থানে রাখিয়া
দিল। দীপবর্ত্তিকা লইয়া পুনরায় সেই ছবির পশ্চাদ্ভাগ
অনুসন্ধান করিয়া দেখিল, সত্যসত্যই সেখানে ছুরির ভাঙা
বাঁটখানা পড়িয়া রহিয়াছে। শ্রীশ তখনই ছুরিখানি ঠিক
করিয়া সেই বাঁটের মধ্যে বসাইয়া দিল; তখন তাহার আর
কোন সন্দেহ রহিল না, এই ছুরিই বটে।কার্যে্যাদ্ধার
হইয়াছে, শ্রীশের মনে আর আনন্দ ধরে না-এমন কি আনন্দে
সে লাফাইবে-কি নাচিবে-কিছুই ঠিক করিতে পারিল না; কিন্তু
লাফাইবার অথবা নাচিবার সে সময় নহে- সে জ্ঞান শ্রীমান্
শ্রীশচন্দ্রের খুব ছিল। ছুরিখানা বিষাক্ত; পাছে, অসাবধানে
কোথায় কাটিয়া-কুটিয়া যায়, এই ভয়ে সেই শ্রীশ একখানি
ইংরাজী খবরের কাগজ ছিড়িয়া আট-দশ ভাঁজে সেই ছুরিখানা
মুড়িয়া তখনই তাহা কটির বসনাভ্যন্তরে অতি সন্তর্পণে
লুকাইয়া ফেলিল। শ্রীশ এত সত্বর-এত দ্রুতহস্তে এই সকল
কাজ শেষ করিয়া ফেলিল যে, দেখিয়া আশ্চর্য্য বোধ হয়।
এমন সময়ে বাহির সোপানে মজিদ খাঁর দ্রুত পদশব্দ শ্রুত
হইল। ইতিপূর্ব্বে গৃহতলে যেখানে পড়িয়া ছট্ফট্ করিতেছিল,
পুনরায় সে ঠিক সেইস্থানে নিজের ক্ষুদ্র দেহখানা বিস্তার
করিয়া দিল; এবং পূর্ব্বভাব অবলম্বন করিয়া হাত-পা ছুঁড়িতে
লাগিল-এ পাশ ও-পাশ করিতে লাগিল। শ্রীশ বাহাদুর ছেলে!
তৃতীয়
পরিচ্ছেদ
কে ধরা পড়িল?
এমন
সময়ে মজিদ খাঁ দুগ্ধপূর্ণ একটা বড় কাচের পেয়ালা হস্তে
কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিলেন। দুগ্ধ হইতে ধুঁয়া উড়িতেছে।
মজিদ দুঃখিত ভাবে কহিলেন, "বড় কষ্ট হইতেছে-না?"
শ্রীশ রোদনের সুরে কহিল, " বড় কষ্ট-পেট জ্ব'লে
গেল-বুক পর্য্যন্ত শুকিয়ে গেছে-হুজুর-আমি আর বাঁচব
না!"
"ভয় কি!" বলিয়া জানুতে ভর দিয়া মজিদ শ্রীশের
মাথার কাছে বসিলেন। বসিয়া বলিলেন, "এই দুধটুকু
খেয়ে ফেল দেখি; গায়ে এখনই জোর পাবে।"
শ্রীশ অনেক কষ্টে (?) উঠিল। এবং দুধের পেয়ালা নিজের
হাতে লইয়া পান করিতে আরম্ভ করিয়া দিল।
মজিদ নিকটস্থ একখানা চেয়ারে বসিয়া, একটা চুরুটে অগ্নিসংযোগ
করিয়া টানিতে আরম্ভ করিয়া দিলেন, এবং প্রসন্ননেত্রে
বালক শ্রীশের দুগ্ধ পান দেখিতে লাগিলেন।
হায়, হতভাগ্য মজিদ! তুমি এখনও বুঝিতে পার নাই-কালসর্পকে
দুগ্ধ দিয়া পোষণ করিতেছ-এখনই একটা সুযোগ পাইলে সে
তোমাকেই দংশন করিবে। দুগ্ধপান শেষ করিয়া শ্রীশ ভাবভঙ্গিতে
জানাইল, সে অনেকটা সুস্থ হইতে পারিয়াছে। সুস্থ হইবার
কথা-এক সেরের অধিক দুগ্ধ তাহাকে দেওয়া হইয়াছিল।
মজিদ জিজ্ঞাসা করিলেন, " আর কিছু খাবে?"
শ্রীশ বলিল, " আর কিছু না-হুজুরের দয়ায় এ যাত্রা
বেঁচে গেলাম-আপনি না দয়া কর্লে এতক্ষণে জাহান্নমে
যেতে হ'ত।"
মজিদ তাহাকে কিছু পয়সা দিলেন। বলিলেন, "এই পয়সা
নিয়ে যাও, এখনও খাবারের দোকান খোলা আছে, কিছু খাবার
কিনে খাও গিয়ে।"
শ্রীশ ছাড়িবার পাত্র নহে-অনেকগুলি পয়সা ট্যাঁকে গুঁজিয়া
বাহির হইয়া পড়িল।
মজিদ খাঁ নিজের ঘরের দ্বার বন্ধ করিলেন। তখন ঝড়-বৃষ্টি
থামিয়া গিয়াছিল। আকাশ পরিষ্কার-মজিদ খাঁ সমুদয় গবাক্ষগুলি
খুলিয়া দিলেন। গবাক্ষপথে চাহিয়া দেখিলেন, সেই অনাহারক্লিষ্ট
বালক, এক্ষণে পার্শ্বস্থ গলিপথে দিয়া উর্দ্ধশ্বাসে
ছুটিয়া চলিয়াছে। আপনমনে বলিলেন, "পরোপকারে মনের
তৃপ্তি হয়-ফলও আছে।"
বলিতে কি, মজিদ এই পরোপকারে যে ফলপ্রাপ্ত হইলেন, তাহা
পাঠক নিম্নলিখিত কয়েকটি পংক্তি পাঠে বুঝিতে পারিবেন।
পরদিন অপরাহ্নে মজিদ নিজের ঘরে বসিয়া মনিরুদ্দীনের
জমিদারী সংক্রান্ত হিসাব-নিকাশ ঠিক করিতেছিলেন।
এমন সময়ে দুই ব্যক্তি আসিয়া তাঁহার পার্শ্বে দাঁড়াইলেন
তন্মধ্যে একজন দেবেন্দ্রবিজয়, একজন স্থানীয় থানার
জমাদার। মজিদ খাঁ দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখের দিকে চকিতে
চাহিয়া বলিলেন, "মহাশয়, আবার কি মনে ক'রে?"
দেবেন্দ্রবিজয় পকেট হইতে একখানি ওয়ারেন্ট বাহির করিয়া
দেখাইলেন। মজিদ আরও চমকিত হইয়া, মহা ভয় পাইয়া কহিলেন,
" কি সর্ব্বনাশ! এ ওয়ারেন্ট যে আমারই নামে! আমি
কি করিয়াছি?"
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন, "আপনি দিলজানকে হত্যা
করিয়াছেন। সেই হত্যাপরাধে মহারাণীর নাম লইয়া আপনাকে
এখন বন্দী করিলাম।"
তখনই মজিদ খাঁর হাতে সশব্দে হাতকড়ি পড়িল। মজিদ খাঁ
বন্দী হইলেন।
চতুর্থ
পরিচ্ছেদ
মনে মনে নানা ভাবের প্রাবল্য
দেবেন্দ্রবিজয়
তাড়াতাড়ি গ্রেপ্তার করিলেন বটে, কিন্তু মজিদ দোষী
কি নির্দ্দোষ, তাহা ঠিক বুঝিতে পারিলেন না। তাঁহার
মনের ভিতরে সেই সন্দেহ পূর্ব্ববৎ রহিল। যে ছুরিতে
খুন হইয়াছে, সেই ছুরিকানি মজিদ খাঁর গৃহে পাওয়া গিয়াছে-ইহা
একটা খুনের বিশিষ্ট প্রমাণ বটে; এবং এই প্রমাণের উপর
নির্ভর করিয়াই তিনি মজিদ খাঁকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন;
কিন্তু মজিদ যে দিলজানকে খুন করিয়াছেন, তাহার কোন
সুবিধাজনক কারণ দেখিতে পাইলেন না। তিনি বুঝিয়াছিলেন,
এ খুনটা অত্যন্ত জটিল রহস্যে পূর্ণ-ইহার স্থির-সিদ্ধান্তে
উপনীত হওয়াও কঠিন। এরূপ স্থলে এখন যাহার উপরে একটুমাত্র
সন্দেহ হইবে, তাহাকে ধরিয়া নাড়াচাড়া দিতে হইবে-নতুবা
সহজে রহস্যোদ্ভেদ হইবে না; সেইজন্য দেবেন্দ্রবিজয়
মজিদ খাঁকে ঠিক দোষী বলিয়া বুঝিতে না পারিলেও তাঁহাকে
গ্রেপ্তার করা যুক্তিসঙ্গত বোধ করিয়াছিলেন। যেমন সেই
ছুরিতে একদিকে মজিদের উপরে দেবেন্দ্রবিজয়ের সন্দেহ
প্রবল হইয়াছে; আর একদিকে শ্রীশ প্রমুখাৎ মজিদ ও জোহেরার
কথোপকথন সম্বন্ধে যাহা তিনি শুনিয়াছিলেন, তাহাতে মজিদের
উপর হইতে সন্দেহটা কিছু হাল্কা হইয়াও গিয়াছে। মজিদের
কথার ভবে বুঝা যায়, তিনি নিজেই মনিরুদ্দীনকে সন্দেহ
করিতেছেন। দেবেন্দ্রবিজয় আবার ভাবিলেন, " এমনও
হইতে পারে, মজিদ জোহেরাকে মিথ্যা বলিয়াছে-আত্মদোষ
ক্ষালনার্থে অনেকেই পরের উপর ঝোঁক্ দিয়া থাকে। মজিদ
হয় দোষী, না হয় কোন-না-কোন রকমে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত
আছেন। আরও বেশ বুঝা যাইতেছে, সৃজান বিবির গৃহত্যাগের
সহিত এই খুনের মাম্লার কিছু সংশ্রব আছে। খুনের রাত্রে
যে স্ত্রীলোক সৃজান বিবির সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিল,
সে কে? দিলজান? দিলজান কেন তাহার সহিত দেখা করিতে
যাইবে? দিলজানের কি সহসা এতখানি সাহস হইতে পারে? সে
বারাঙ্গনা-মুন্সী জোহিরুদ্দীনের অন্তঃপুরে প্রবেশ
করা তাহার পক্ষে সম্ভবপর নহে। তবে এরূপও হইতে পারে,
সৃজান বিবি তাহার মনিরুদ্দীনকে কাড়িয়া লইতেছে দেখিয়া,
সে সৃজান বিবিকে দুই একটা কঠিন কথা শুনাইয়া দিবার
লোভ সংবরণ করিতে পারে নাই। এইরূপ গাত্রদাহ উপস্থিত
হইলে রমণীমাত্রেই দিগবিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া পড়ে;
এবং তখন তাহাদের ভালমন্দ বিবচনা করিবার ক্ষমতা থাকে
না। আমার বিশ্বাস, নিশ্চয়ই সে দিলজান। দেখিতেছি, এ
রহস্য-সমুদ্রের তলদেশ পর্য্যন্ত আমাকে নামিতে হইবে।"
মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া দ্দেবেন্দ্রবিজয় বাটী হইতে
সাধারণ ভদ্রলোকের মত সাদাশিধে পোষাকে বাহির হইয়া পড়িলেন;
এবং লতিমন বাইজীর বাটী-অভিমুখে চলিলেন।
লতিমন বাইজী এবার দেবেন্দ্রবিজয়কে খুব খাতির করিয়া
নিজের ঘরে লইয়া বসাইল। লতিমন দিলজানকে খুব ভালবাসিত।
যাহাতে তাহার হত্যাকারী শীঘ্র ধরা পড়িয়া স্ব-কৃত পাপের
ফলভোগ করে, তাহাতে লতিমন বাইজীরও খুব আগ্রহ দেখা গেল।
এক্ষণে সে দেবেন্দ্রবিজয়কে প্রচুর সাহায্য করিতেও
প্রস্তুত। প্রথম হইতেই সে অযাচিতভাবে দেবেন্দ্রবিজয়ের
প্রতি বহুবিধ উপদেশ বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিয়া দিল।
কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয় তাহাতে কাজের কথা কিছুও পাইলেন
না। তিনি নিজের একেবারে নিজের কথাই পাড়িলেন! বলিলেন,
"সেদিন রাত্রে দিলজান বাটী হইতে বাহির হইয়া যাইবার
সময়, কোথায় সে যাইতেছে, সে সম্বন্ধে আপনাকে কিছু বলিয়া
গিয়াছিল?"
লতিমন বলিল, "তাহা ত আপনাকে পূর্ব্বেই বলিয়াছি,
সে মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে যাইবে বলিয়া বাহির হইয়াছিল।"
দেবেন্দ্রবিজয় জিজ্ঞাসিলেন, কেবল মনিরুদ্দীনের বাড়ীতে?
আর কোথায় নহে কি?
লতি। কই, আমাকে আর কোনখানে যাইবার কথা কিছু বলে নাই।
দেবেন্দ্র। নাই বলুক-তার ভাব-গতিক দেখিয়া ত কোন কথায়
আপনি কি তখন এরূপ একটা অনুমান করিতে পারেন নাই যে,
দিলজান সৃজান বিবির নিকটেও যাইবে?
লতি। (সবিস্ময়ে) সৃজান বিবি! সৃজান বিবির কাছে সে
কি করিতে যাইবে?
দে। কি করিতে যাইবে, তা' আমি কি করিয়া বলিব? আমার
ধারণা যাহা হউক, একটা-কিছু করিতে সে গিয়াছিল।
দেবেন্দ্রবিজয়, মজিদ ও জোহেরার সেই কথোপকথনের সারাংশ
লতিমন বাইজীকে শুনাইয়া দিলেন। বাইজী এতক্ষণে রুদ্ধ
নিঃশ্বাসে সব শুনিয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল,
"তা' হবে-আর্শ্চয্য কি! আমি ত ইহার কিছুই জানি
না।"।
দে। তা' না জানেন-ক্ষতি নাই। মুন্সী জোহিরুদ্দীনের
বাড়ীর দাসী-বাঁদীদের কাহাকেও আপনি চিনেন কি?
লতি। চিনি একজনকে আমি খুব চিনি, সে আমার এখানে দুই-তিন
মাস কাজ করিয়া গিয়াছে। তার নাম সাখিয়া-সে এখন খোদ
সৃজান বিবিরই বাঁদী।
দে। (সাগ্রহে) বটে! তবে সে নিশ্চয় অনেক খবরই রাখে।
কোন রকমে এখন তাকে এখানে যদি একবার আনাইতে পারেন,
তাহা হইলে আমার অনেকটা উপকার হয়। তাহার মুখ হইতে সকল
কথাই আমি বাহির করিয়া লইতে পারি।
লতি। কেন পারিব না? আমার কথা সে কখনই ঠেলিবে না। এখন
কর্ত্রী নাই, কাজকর্ম্মও তার হাতে বিশেষ কিছু নাই;
খবর পাইলে এখনই সে আসিবে। আমি তার কাছে লোক পাঠাইতেছি।
দে। এখনই একজন লোক পাঠাইয়া দিন্, বিলম্ব করিবেন না।
যতক্ষণ না সে আসে, ততক্ষণ আমাকে তাহার অপেক্ষায় এখানেই
বসিয়া থাকিতে হইবে।
আচ্ছা, আমি এখনই ইহার বন্দোবস্ত করিতেছি," বলিয়া
লতিমন ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইবার উপক্রম করিল। যেমন
সে দ্বারের নিকট গিয়াছে দেবেন্দ্রবিজয় তাহাকে বলিলেন,
" দাঁড়ান, আর একটা কথা আছে।"
লতিমন ফিরিয়া দাঁড়াইল।
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, " আমি দিলজানের ঘরটা একবার
অনুসন্ধান করিয়া দেখিতে চাই; বিশেষতঃ বাক্স-দেরাজগুলি
আমাকে একবার ভাল করিয়া দেখিতে হইবে।"
শিহরিত হইয়া সভয়ে লতিমন বলিল, "কেন, বাক্স-দেরাজ
দেখিয়া কি হইবে?"
দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, "দেরাজ-বাক্সে লোকে অনেক
রকম জিনিষ রাখে। গুপ্তচিঠি-পত্রও থাকিতে পারে, বিশেষতঃ
কোন গুরুতর কারণ উপস্থিত না হইলে স্ত্রীলোক সহজে চিঠি-পত্র
নষ্ট করে না। প্রেমপত্রাদি আরও যত্নপূর্ব্বক রক্ষা
করে। যদি দিলজানের সেই রকম দুই-একখানা চিঠিপত্র পাওয়া
যায়, হয়ত তাহা হইতে দিলজানের পূর্ব্ব-জীবনের অনেক
কথা প্রকাশ পাইতে পারে। আর কোন উদ্দেশ্যে কে তাহাকে
খুন করিয়াছে, তাহাও জানা যাইতে পারে। আমাদের দেখা
আছে, গুপ্তচিঠিপত্রে অনেক সময়ে অনেক কাজ হয়।"
চিন্তিতভাবে লতিমন ক্ষণপরে কহিল, "তাহা হইলে
মজিদ খাঁকে খুনী বলিয়া আপনার বোধ হয় না?"
দেবেন্দ্রবিজয় কহিলেন," সে কথা এখন কিরূপে বলিল্ব?
আমি এখন কোন কারণ খুঁজিয়া পাই না, যাহাতে মজিদ দিলজানকে
খুন করিয়াছে বলিয়া একটা স্থির-সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে
পারি। মজিদ দিলজানকে কেন খুন করিবে? অবশ্যই ইহার ভিতরে
একটা অভিপ্রায় থাকা চাই-হাসি-তামাসার কথা নহে-খুন।
চলুন, এখন আপনি আমাকে একবার দিলজানের ঘরে লইয়া চলুন
দেখি।"
একটু ইতস্ততঃ করিয়া লতিমন কহিল, "সে কাজটা কি
ঠিক হয়? আমার বিবেচনায় পরের বাক্স-দেরাজটা খোলা- "
দেবেন্দ্রবিজয় উচ্চহাস্য করিয়া, বাধা দিয়া বলিলেন,
"ক্ষতি কি আছে? আপনার দিলজান ত এ জগতে নাই। তাহার
হত্যাকারীকে উপযুক্ত দণ্ড দিবার জন্যই আমরা তার বাক্স-দেরাজ
খুলিতে চাই-কোন মন্দ উদ্দেশ্য ত নাই। এই উপলক্ষে হয়
ত একজন নির্দ্দোষীর জীবনরক্ষাও হইতে পারে।"
লতিমন আর আপত্তি করিল না। দিলজান যে ঘরে বাস করিত,
দেবেন্দ্রবিজয়কে সেখানে লইয়া গেল। দেবেন্দ্রবিজয় পূর্ব্বে
আর একবার মাত্র এই ঘরে আসিয়া ছিলেন। সেইদিন এই ঘরেই
তিনি সেই বিষাক্ত ছুরি পাইয়াছিলেন। পাঠক তাহা অবগত
আছেন।
দেবেন্দ্রবিজয় প্রথমেই দিলজানের বাক্সের ডালা ও দেরাজের
ড্রয়ারগুলি টানিয়া দেখিতে লাগিলেন,-সকলগুলিই চাবি
বন্ধ। লতিমনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "আপনার কাছে
দিলজান চাবি রাখিয়া গিয়াছিল?"
লতিমন বলিল, "না, কেবল ঘরের চাবি আমার কাছে দিয়া
গিয়াছে, আর সব চাবি তাহারই সঙ্গে ছিল।"
দেবেন্দ্রবিজয় চিন্তিত হইলেন। তাহার পর বলিলেন, "চাবি
না থাকে, আপনি এক কাজ করুন আমাকে খানিকটা লোহার তার
আনিয়া দিন, ছাতা ভাঙ্গা লোহার শিক্ একটু যদি আনিতে
পারেন, খুব সুবিধা হয়।"
"যাই-খুঁজিয়া দেখি, আর অমনি সাখিয়াকে আনিবার
জন্য একজন বান্দাকেও পাঠাইয়া দিয়া আসি, "বলিয়া
লতিমন ঘরের বাহির হইয়া গেল। এবং ক্ষণপরে একটী ছাতার
শিক ও খানিকটা লোহার তার লইয়া ফিরিয়া আসিল।
দেবেন্দ্রবিজয় লোহার তার ও শিক হাতে লইয়া জিজ্ঞাসিলেন,
"সাখিয়ার কাছে খবর গেল?"
লতিমন কহিল, "হাঁ, খবর পাঠাইয়াছি।"
তাহার
পর দেবেন্দ্রবিজয় সেই লোহার তার ও শিকের সাহায্যে
দিলজানের বাক্স ও ড্রয়ারগুলি খুলিয়া ফেলিতে লাগিলেন;
এবং তন্মধ্যস্থিত জিনিষ-পত্র সমুদয় উল্টাইয়া-পাল্টাইয়া
দেখিতে লাগিলেন। প্রায় একঘন্টা কঠিন পরিশ্রমের পর
নিজের কাজে লাগিতে পারে, এমন দুই-একটি মাত্র জিনিষ
তাঁহার হস্তগত হইল' তাহা একতাড়া পুরাতন চিঠী এবং দুইখানি
ফটোগ্রাফ ভিন্ন আর কিছু নহে। চিঠীগুলি আমীর খাঁ নামক
কোন ব্যক্তি মৃজান নাম্নী কোন রমণীকে লিখিতেছে। সকলগুলিই
প্রেমপত্র, তাহা ভালবাসার কথা-বিরহের কথা-অন্তরঙ্গতার
কথা ও অনন্তবিধ হা-হুতাশে পূর্ণ। ফটোগ্রাফ্ দুইখানির
একখানিতে একটি শুক্লকেশ বৃদ্ধ মুসলমানের প্রতিকৃতি
অঙ্কিত। তাহার পরপৃষ্ঠায় লেখা-"মুন্সী মোজাম
হোসেন-সাং খিদিরপুর।" অপর ফটোখানি দিলজানের নিজের।
ইহাতে দিলজান সালঙ্কারা নীলবসনা নহে, শুভ্রবসনা নিরলঙ্কারা-তথাপি
তাহা বড় সুন্দর দেখাইতেছে। অবেণীসম্বন্ধ কেশগুচ্ছ-গুচ্ছে
গুচ্ছে সুন্দর মুখখানির উভয় পার্শ্বে বেষ্টন করিয়া
অংসে পৃষ্ঠে এবং বক্ষের উপরে লুটাইয়া পড়িয়াছে। তুলিকাচিত্রিতবৎ
আকর্ণবিশ্রান্ত বঙ্কিম ভ্রুযুগল, এবং ভাসা ভাসা প্রচুরায়ত
ও কৃষ্ণচক্ষু দু'টী সে সুন্দর মুখমণ্ডলের অপূর্ব্ব
শোভাবর্দ্ধন করিতেছে। সেই ডাগর চক্ষু দুটীতে তেমনিই
আবার কি মনোমোহিনী দৃষ্টি! তাহার পর, আরও মনোহর সেই
উন্নত গ্রীবার বঙ্কিম ভঙ্গি। প্রসৃত পরিপুষ্ট বক্ষের
উর্দ্ধার্দ্ধভাগ উন্মুক্ত। একটি কুসুমিতা লতা মালার
সেই মত অংস ও কণ্ঠ বেষ্টন করিয়া সেই কামদেবের লীলা-ক্ষেত্রতুল্য
সমুন্নত বক্ষের উপরে আসিয়া পড়িয়াছে।
দেবেন্দ্রবিজয় ফটোগ্রাফ্ দুইখানি বিশেষরূপে পর্য্যবেক্ষণ
করিয়া একে একে পত্রগুলি পড়িতে আরম্ভ করিলেন। দশ-দশখানি
সুদীর্ঘ পত্র-দেবেন্দ্রবিজয় সকলগুলিরই আদ্যোপান্ত
বিশেষ মনোযোগের সহিত মনে মনে পাঠ করিলেন। পাঠ শেষ
করিয়া তিনি লতিমনের মুখের দিকে চাহিলেন। লতিমন এতক্ষণে
নীরবে তাহার মুখের দিকে অবাক্ হইয়া চাহিয়াছিল। দেবেন্দ্রবিজয়
তাহাকে বলিলেন, "ঘটনা যাহা ঘটিয়াছে, এতক্ষণে
সব বুঝিলাম। আপনি যাহাকে দিলজান বলিয়া জানেন, তাহার
প্রকৃত নাম দিলজান নহে-মৃজান। খিদিরপুরে তাহার পিতৃগৃহ।
তাহার পিতার নাম মোজাম হোসেন। ঘটনাক্রমে পিতৃগৃহে
মনিরুদ্দীনের সহিত তাহার প্রণয় হয়। মনিরুদ্দীন নিজের
নাম গোপন করিয়া আমীর খাঁ নামে তাহার নিকটে পরিচিত
হইয়া ছিলেন। মৃজান আমীর খাঁকে বিবাহ করিবার জন্য পীড়াপীড়ি
করে; কিন্তু আমীর খাঁ সে সকল কথা উড়াইয়া দিয়া তাহাকে
গৃহের বাহির করিবার চেষ্টা করে। পরিশেষে মনিরুদ্দীনেরই
চেষ্টা সফল হইল। পরে যখন মৃজান বুঝিল, কাজটা সে নিতান্ত
বুদ্ধিহীনার মত করিয়া ফেলিয়াছে, নিজে কলঙ্ক-সাগরে
ডুবিয়াছে, এবং সেই কলঙ্কের কালিমা তাহার বৃদ্ধ পিতার
মুখে লেপন করিয়াছে, তখন আত্ম-পরিচয় গোপন করিয়া দিলজান
নাম লইয়া থাকিল।এই যে বৃদ্ধের তস্বীর দেখিতেছেন, ইনিই
দিলজানের পিতা, নাম মোজাম হোসেন। আর এইখানি সেই আপনার
মৃজান ওরফে দিলজানের তস্বীর।"
লতিমন মনোহর রূপকথার মত দেবেন্দ্রবিজয়ের মুখে এই প্রেম
কাহিনী একান্ত বিস্ময়ের সহিত শুনিল। সে বুঝিতে পারিল
না, দেবেন্দ্রবিজয় কিরূপে ক্ষণকালের মধ্যে এত কথা
জানিতে পারিলেন। নিজে সে এতদিন দিলজানের সহিত একসঙ্গে
বাস করিতেছে, অথচ সে নিজে ইহার বিন্দু-বিসর্গ জানে
না। লতিমনের বিস্ময়ের সীমা রহিল না। সে দেবেন্দ্রবিজয়ের
হাত হইতে ফটোগ্রাফ্ দুইখানি লইয়া, নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিয়া
সমুখস্থ টেবিলের উপরে রাখিয়া দিল। এবং একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস
ত্যাগ করিয়া কহিল, "হাঁ, একখানি দিলজানের তস্বীর।
এখানে আমি তাহাকে কখনও এ রকম পোষাকে দেখি নাই।"
দেবেন্দ্রবিজয় কি বলিতে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে দ্বার
ঠেলিয়া আর একটি স্ত্রীলোক তথায় প্রবেশ করিল। স্ত্রীলোক
দীর্ঘাঙ্গী, কৃশা শ্যামবর্ণা। তাহার বয়ঃক্রম পঁচিশ
হইতে পারে-পঁয়ত্রিশও হইতে পারে-ঠিক করা কঠিন। তাহাকে
দেখিয়া সাগ্রহে লতিমন বলিয়া উঠিল, "কে, সাখিয়া
না কি? বেশ-বেশ-খুব শীঘ্র এসে পড়েছিস্ ত!"
দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, এই সাখিয়া সৃজান বিবির প্রধানা
দাসী। তিনি তাহার মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চাহিয়া
রহিলেন।
সাখিয়া, দেবেন্দ্রবিজয়কে তেমন কঠিনভাবে তাহার দিকে
চাহিতে দেখিয়া ভীতা হইল। একটু যেন থতমত খাইয়া গেল।
কি বলিবে, স্থির করিতে না পারিয়া চুপ করিয়া রহিল।
তখন লতিমন সাখিয়াকে দেবেন্দ্রবিজয়ের পরিচয় দিল। শুনিয়া
সে আরও ভীতা হইয়া উঠিল।
লতিমন বলিল, "সাখিয়া, ইনি তোকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা
কর্তে চান্। যা' জানিস্ সত্য বলবি।"
সাখিয়া শুনিয়া মনে মনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইল। বলিল,
"কি মুস্কিল! আমি কি জানি, আমি কি বলব? থানা-পুলিসের
হাঙ্গামে আমি নেই।"
দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, সকলই বিগ্ড়াইয়া যায়। তিনি
সাখিয়াকে বুঝাইয়া বলিতে লাগিলেন, "না-না-থানা
পুলিসের হাঙ্গামা ইহাতে কিছুই নাই। যে রাত্রে সৃজান
বিবি পলাইয়া যায়, সেই রাত্রের দুই-একটা খবর আমি তোমার
কাছে জনিতে চাই। আমি পুলিসের লোক ঠিক নই-একজন গোয়েন্দা।
মুন্সী জোহিরুদ্দীন আমাকে নিযুক্ত করিয়াছেন। তিনি
আমার উপরেই সৃজান বিবিকে সন্ধান করিয়া বাহির করিবার
ভার দিয়াছেন। তা' তোমাদের মত দুই-একজন লোক যদি এ সময়ে
আমায় সাহায্য না করে, তা হইলে আমি একা কতদূর কি করিতে
পারি? ইহাতে শুধু আমার উপকার করা হইবে না-তোমার মনিবেরও
যথেষ্ট উপকার হইবে।"
শুনিয়া সাখিয়া মনে মনে সন্তুষ্ট হইল। বলিল, "এমন
মনিব আর হয় না! বিবি সাহেবাকে তিনি কত ভালবাস্তেন-একদণ্ড
চোখের তফাৎ করতেন না! এমন কি-"
দেবেন্দ্রবিজয় বাধা দিয়া বলিলেন, "তোমার মনিব
সাহেবের ভালবাসার কথা পরে শুনিব; এখন বিবি সাহেবার
কথা কি জান, তাহাই আগে বল। একটা ভয়ানক খুনের মামলা
ইহার ভিতরে রহিয়াছে।"
চোখ মুখ কপালে তুলিয়া সভয়ে বলিল, "খুন! কে খুন
হয়েছে-আমাদের বিবি সাহেবা না কি?"
চোখে দুই ফোঁটা জল আনিয়া লতিমন বলিল, "না সাখিয়া,
তোর বিবি সাহেবা নয়-আমাদেরই কপাল ভেঙ্গেছে-দিলজান
খুন হয়েছে।"
সাখিয়া বলিল, "তাই ভাল-একটা বেশ্যা মাগী খুন
হয়েছে, তার আবার কথা। আমি মনে করেছিলুম, আমাদের বিবি
সাহেবা।"
লতিমন রাগিয়া বলিল, "রেখে দে তোর বিবি সাহেবা-সে
আবার বেশ্যার অধম; নৈলে সে এমন কাজ করে? তার আবার
মান! আমাদের দিলজানের সঙ্গে তার তুলনা? যদিও মনিরুদ্দীনের
সঙ্গে দিলজানের বিবাহ হয় নাই; তা' না হ'লেও, সে মনিরুদ্দীন
ভিন্ন আর কিছু জানিত না। তোর বিবি সাহেবা কি নামটাই
কিন্লে বল্ দেখি? তোর বিবি সাহেবা যদি মনিরুদ্দীনের
মাথাটা একেবারে না খেয়ে দিত, তা'হ'লে আমাদের দিলজানই
বা খুন হবে কেন?"
সাখিয়া ক্রোধভরে উঠিয়া কহিল, "বেশ-তোমাদের দিলজান
খুব সতী-আমাদের বিবি সাহেবার সঙ্গে তুলনা হয় না! তোমরা
যে কেন আমাকে ডেকেছ, তা' আমি বেশ বুঝ্তে পেরেছি; এখন
ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এই খুন খারাপীটা বিবি সাহেবার ঘাড়ে
ফেলিতে চাও; আমি সব বুঝিতে পারি। আমি নিতান্ত আর ছেলে
মানুষটি ত নই-আমি তোমাদের এ সব কথায় নেই-আমি কিছুই
জানি না, " বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া যাইবার
উপক্রম করিল। দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, আগেই খুনের কথা
তুলিয়া নিজে আবার সব মাটি করিয়া ফেলিলেন। এখন আর বিনয়
ছলে কিছু হইবে, এমন বোধ হয় না; বলপ্রয়োগ প্রয়োজন।
তিনি তৎক্ষণাৎ প্রস্থানোদ্যতা সাখিয়ার বস্ত্রাঞ্চল
ধরিয়া, সজোরে একটা টান্ দিয়া কঠোরকণ্ঠে বলিলেন, "আরে
ব'স মাগী, যবি কোথায়? যা জনিস্, তোকে এখনই বল্তে হবে-চলাকী
করতে গেলে একেবারে পুলিসে চালান্ দিব জানিস্?"
সাখিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িয়া, হাঁউমাউ করিয়া কাঁদিয়া
উঠিল। এবং এক্ষণে যে ধর্ম্মকর্ম্ম ও ভাল মানুষের দিন-কাল
আর নাই, এবং ইংরাজের এত বড় রাজত্বটা সহসা মগের মুল্লুকে
পরিণত হইয়াছে, অতিশয় বিস্ময়ের সহিত সে তাহাই বারংবার
উল্লেখ করিতে লাগিল।
পাঁচকড়ি
দে
পাঁচকড়ি
দে (১৮৭৩ – ১৯৪৫) সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রথম মৌলিক ডিটেকটিভ
কাহিনীর লেখক। রহস্যকাহিনী লিখে উনি নাকি প্রচুর অর্থ উপার্জন
করেছিলেন। ওঁর লেখা ‘নীলবসনা সুন্দরী’, ‘মনোরমা’, ‘মায়াবী’, ‘হত্যাকারী
কে?’ এক কালে পাঠকজগতে আলোড়ন তুলেছিল। পাঁচকড়ি দে প্রধানতঃ উইল্কি
কলিন্স ও এমিল গাবোরিয়র-এর ধারা অনুসরণ করলেও, পরে কোনান ডয়েলের
লেখা থেকে প্রচুর উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। তবে ওঁর বৈশিষ্ট্য ছিল
বিদেশী মালমশলাকে দেশী ছাঁচে ফেলে পাঠকদের বিতরণ করা। ওঁর অনেক
লেখা বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল।
|