প্রেমের
প্রান্তে পরাশর
সাত
ঠিক ঐ কথাই ভাবতে ভাবতে নয়
কেমন একটু বিভ্রান্ত অবস্থায় মাঝপথে জ্যোতিষ চক্রবর্তীর বাড়ির
সামনে গাড়ি থামিয়ে তাঁর পাঠিয়ে দেওয়া গালা-আঁটা খামটা নিয়ে পাঁচতারা
হোটেলে যখন গিয়ে পৌঁছ্হোলাম, তখন হোটেলের বাইরে বা ভেতরে অস্বাভাবিক
কোনো কিছুই কিন্তু দেখতে পেলাম না। সকালের দিকে এ ধরণের বড় হোটেলে
যে একটা প্রায় নিঃশব্দ ব্যস্ততা থাকে তার বেশী সেখানে কিছুর চিহ্ন
নেই। লবির কাউণ্টারে
পরাশর সত্যিই আমার জন্যে অপেক্ষা করছে। সে একা নয় তার সঙ্গে আরেকজনও
আছেন।আমি গিয়ে দাঁড়াতেই
পরাশর পরিচয় করিয়ে দিলে। "মিঃ ভদ্র, মিঃ সেঙ্গার - হোটেলের
ম্যানেজার।"
ম্যানেজার সেঙ্গার
ভারতীয় কিন্তু পোষাক-আশাক চাল-চলন এমনকি চেহারা দেখেও তা বোঝা
খুব সহজ নয়। বছর চল্লিশের অত্যন্ত সুঠাম, আর যাকে বলা যায় ব্যায়াম-সাধা
মজবুত চেহারা। রংটা ইউরোপীয়দের মতই প্রায় ফর্সা হওয়ার দরুণ ভুলটা
সহজেই হতে পারে।
তিনি একটু হেসে করমর্দনের
বদলে হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে ইংরেজীর বদলে হিন্দীতেই বললনে,
"আপনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছি মিঃ ভদ্র। আপনার কামরা ঠিক
করাই আছে। আশা করি আপনার কোনো অসুবুধে হবে না।"
আমি পরাশরের পাঠানো গাড়ি
থেকে নামবার পরেই হোটেলের ইউনিফর্ম-পরা পোর্টার আমার লাগেজ বয়ে
এনে আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমায় অভ্যর্থনা জানাবার জানাবার
পরই ম্যানেজার পরই ম্যানেজার তাকে আমার রুম নম্বর জানিয়ে সেখানে
আমার লাগেজ নিয়ে যেতে বললেন। কাউণ্টারের রিসেপশন ক্লার্কের কাছ
থেকে কামরার চাবি নিয়ে সে এগিয়ে যেতে তার পিছু নিতে হল। কিন্তু
পরাশর ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল কেন? সে আমার সঙ্গে আসবে না? কি কারণে
এমন অদ্ভুত ছুতো করে আমায় এখানে আসতে হল তা বোঝাবে তাহলে কখন।
আমার পকেটে জ্যোতিষ চক্রবর্তীর গালা আঁটা চিঠিটাও ত তাকে দেওয়া
হল না। পরাশর আমায় পরিচয় করিয়ে দেবার সময় পকেটে হাত দিয়ে একবার
সেটা বার করতে গেছলাম, কিন্তু হঠাৎ পরাশরের চোখের ইঙ্গিতটা দেখে
আর এগোই নি।পরাশর তাহলে এখানে আমার সঙ্গে পর পর ভাবই রাখবে নাকি?
আমার জন্যে ঘর রিজার্ভ করা টরা সব ত সে- করেছে। সে সব কি করেছে
কি অজুহাত দিয়ে? ট্রাভেল এজেণ্টের ভূমিকায়? একটু দূরত্ব রাখতেই
সে যে চায় তা হোটেলের লবিতে ঢুকে তার পোষাক দেখেই একটু অবশ্য মনে
হয়েছে। আজ আর ধুতি পাঞ্জাবী নয়, একেবারে টাই-ফাই বাঁধা পাক্কা
দামী সাহেবী স্যুট। আমার পরিচয় করিয়ে দিলেও কথাবার্তা যা বলেছে
একটু ছাড়া ছাড়া ভাবেই।এটা
কি ম্যানেজারের কাছে আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্কটা
লুকোবার জন্যে? কিন্তু তাই বা কেন! এই অভিনয় করে কদিন এখন চালাতে
হবে? ক'দিনের জন্যে আমার জন্যে কামরা বুক করা হয়েছে তাও ত কাউণ্টার
থেকে জানবার সুযোগ পেলাম না। এই সব কিছুর জন্যে পরাশরের সঙ্গে
একবার অন্ততঃ আলাপ করবার সুযোগ যে না পেলেই নয়।
হোটেল লিফটে পোর্টারের সঙ্গে ওপরে উঠতে উঠতে এইসব কথাই ভাবছিলাম।
হোটেলের কামরগুলোর চাবি রীতিমত প্রকাণ্ড ও ভারী। বোর্ডারদের পকেটে
করে চাবি বাইরে নিয়ে যাওয়ার উৎসাহটা দমাবার জন্যেই এই ব্যবস্থা।
এ হোটেলের চাবিও যথরীতি প্রকাণ্ড। পোর্টারের হাতে সেটার ওপর বড়
বড় খোদাই করা নম্বরটা ইতিমধ্যে চোখে পড়েছে একবার। তাতে সংখ্যা
লেখা ৪ ২৬। তার মানে চারতলায় আমার ছাব্বিশ নম্বর ঘর।
চারতলায় লিফট থামতে ল্যাণ্ডিং-এ
পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গেই একটু চমকে উঠতে হল। এই ল্যাণ্ডিং-এ নিচে
নামবার জন্যে লিফটের অপেক্ষায় আর কেউ নয়, এলসাই দাঁড়িয়ে। আমি তাকে
চিনলেও সে এই ইউরোপীয় পোষাকে আমাকে প্রথমে ঠিক বোধ হয় চিনতে পারেনি।
হঠাৎ তাকে দেখে একটু থেমে সম্ভাষণ করবার ইচ্ছে হলেও অবস্থা বুঝে
তা দমন করে আমি তখন পোর্টারের পেছনে এগিয়ে যচ্ছি। একটু আড়চোখে
চেয়ে বুঝলুম, প্রথমে না পারলেও তার পরেই চিনতে এলসার ভুল হয় হয়নি।
তবু আরো নিশ্চিত হবার জন্যে সে আমার পিছনেই কয়েক পা এসে কিন্তু
দ্বিধভরে নেমে গেল। সে দ্বিধা কাটিয়ে দেবার চেষ্টা আমি আর করলাম
না। হোটেল জ্যানিটর তখন চাবি কিয়ে আমার কামরার দরজা খুলে ভেতরে
লাগেজ নিয়ে যচ্ছে। তার পিছু পিছু নিজের কামরায় ঢুকে দরজাটা ভেজিয়েই
দিলাম যেন অন্যমনস্কভাবে।
অন্য সময় হলে শুধু কামরাটির
সাজ-সজ্জা বাহার দেখে খানিক মুগ্ধ হয়ে থাকতে পারতাম। তারা চিহ্নগুলো
যে অকারণে লাগান নয় ২৬নং ঘরটির সবকিছুতেই তার প্রমাণ সুস্পষ্ট।
কিন্তু তখন আমার মন অস্থির হয়ে অছে অন্য চিন্তায়। পোর্টার জিনিষপত্র
গুছিয়ে রাখবার পর তাকে একটু ভালো করে বখশিস দিয়ে বিদায় করে দরজাটা
পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম। এবার আমায় নিজের অবস্থাটা ঠিকমত বুঝে
নিতে হবে। জ্যাকেটটা খুলে ওয়ার্ডরোবে রাখতে গিয়ে প্যাকেটে রাখা
শঙ্কর মহারাজের চিঠিটা হাতে ঠেকল। আমার উপস্থিত ভেবে নেবার সমস্যার
মধ্যে এটাও প্রধান একটা। পরাশরকে এ চিঠি দেওয়া যায়নি এখনো। তাকেই
যে দিতে হবে এমন কোনো নির্দেশ অবশ্য চিঠির ওপর নেই! তাহলে ইচ্ছে
করলে আমিও কি গালা-আঁটা খামের মধ্যে কি আছে তা খুলে পড়তে পারি?
খোলবার ইচ্ছেটা প্রবল হলেও গালা-আঁটা থাকাটাই সে ইচ্ছার বাধা হয়ে
দাঁড়াল। পরাশরের মত আমারও পড়বার হলে অত কষ্ট করে গালা লাগান থাকবে
কেন? কিন্তু পরাশর সে চিঠি কখন কিভাবে নেবার ব্যবস্থা করবে? এই
যে এলসার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলেও স্বাভাবিকভাবে তার সঙ্গে আলাপ
করতে পারলাম না, এ বিষয়েও ত পরাশরের পরামর্শ দরকার। যতক্ষণ তার
সঙ্গে কথাবার্তার সুযোগ না হচ্ছে ততক্ষণ আমার করণীয় কি? এই কামরার
মধ্যে বন্দী হয়ে বসে থাকব নাকি! আপাততঃ তাই অন্ততঃ থাকা ছাড়া উপায়
নেই বুঝে হোটেলের ক্যাণ্টিন থেকে এক পট কফি আনিয়ে নেবার জন্যে
রুম সার্ভিস-এ ফোন করতে যাচ্ছিলাম।
ফোনটা তোলার আগেই যন্ত্রটার
তলায় লম্বা ভাঁজ করা কাগজটা চোখে পড়ল। কাগজটার সঙ্গে তার ওপরকার
বড় বড় অক্ষরে বাংলা লেখাটা - খুলে পড়ো। তাই পড়লাম। কোনো সম্বোধন
নেই। নিচে স্বাক্ষরও নয়। কিন্তু কাকে লেখা কে লিখেছে বুঝতে কোন
অসুবিধে হল না ভেতরের চিঠির ভাষা পড়ে। চিঠিটা
এই - পাজামা পাঞ্জাবী যদি সংগে এনে থাকো ভালো। নয়তো শুধু সার্ট-প্যাণ্ট
পরে দোতলায় নেমে এসো এখুনি। লিফটে নেমো না। সিঁড়ি দিয়ে নেমে তেরো
নম্বর কামরায় একটু দেখেশুনে ঢুকবে। করিডরে কেউ নেই দেখলে দরজায়
বেল-টেল না টিপে শুধে একটু ঠেলে ঢুকবে। গালা দেওয়া খামটা সঙ্গে
নিয়ে এসো। এ চিঠিটাও।
আট
এ চিঠির কেন, কি বৃ্ত্তান্ত
ভাবার জন্যে বৃথা সময় নষ্ট না করে তখনই নির্দেশ পালন করলাম । দোতলার
তেরো নম্বর ঘরের দরজা সত্যিই ভেজানো ছিল মাত্র। একটু ঠেলা দিতেই
খুলে গেল। ঘরে ঢুকে সত্যিই একটু থতমত খেয়ে দাঁড়াতে হল। এ কার ঘরে
এসে ঢুকলাম। ওদিকের খাটের ওপর লম্বা হয়ে যে লোকটি কম্বল গায়ে দিয়ে
শুয়ে আছে, মুখ দেখতে না পেলেও চুল দেখে বোঝা যাচ্ছে - ভদ্রলোক
ইউরোপীয়। পরাশরের চিঠির নির্দেশ মানতে গিয়ে এ কার ঘরে এসে ঢুকলাম?
অত্যন্ত সন্ত্রস্ত
হয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে সাবধানে দরজাটা আবার খুলতে
থাকি এমন সময় বিছানায় শায়িত লোকটা পাশ ফিরতে গিয়ে আমায় দেখতে পেয়ে
একটু যেন কষ্ট করে উঠে বসল।
এ কি এ তো বারোহা! এর মধ্যে
তার বিছানার পাশের সাইড টেবিলে, ওষুধের শিশি ও জলের গ্লাস ইত্যাদি
আমি দেখতে পেয়েছি। কি হয়েছে কি বারোহার? শুধু পাশের টেবিলের ওষুধপত্র
নয়, তার চেহারা দেখেও ত অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে। তার
গলার স্বরেও সেটা বোঝা গেল। আমায় দেখে বিস্মিত টিস্মিত নয় একটু
কাতর আর ক্ষীণ হলেও স্বাভাবিক স্বরে সে বললে, "আসুন মিঃ ভদ্র।
আমি আপনাদের অপেক্ষা করছি।" "আমাদেরই
অপেক্ষা করছেন!" কাছে
গিয়ে দাঁড়িযে সবস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "আপনার হয়েছে কি?"
"বিশেষ কিছু নয়!"
দুর্বল গলাতেই বারোহা নিজের অসুস্থতাটা অগ্রাহ্য করে উড়িয়ে দেবার
চেষ্টা করলে, ""কাল একটু বোধ হয় মাত্রা বেশী হয়ে গিয়েছিল
তাই..."
"না ... মাত্রা আপনার
বেশী হয়নি মিঃ বারোহা!" বারোহার
কথার ওপরই পরাশরের গলা শুনতে পেয়ে ফিরে তাকিয়ে শুধু পরাশর নয়,
তার সঙ্গে ম্যানেজার মিঃ সেঙ্গারকে দেখতে পেলাম।
দরজাটা এবার ভালো করে
বন্ধ করে পরাশর ম্যানেজারের সঙ্গে বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে আগের
কথারই জের টানলে, "মাত্রা বেশী হয়েছে ভাবাটা আপনার ভুল। আমরা
রেস্তোরাঁর রেকর্ড বই ত বটেই, টেবিলের ওয়েটার আর বার অ্যাটেণ্ড্যাণ্টদের
কাছেও খবর নিয়েছি। খবর কি পেয়েছি, তা বলুন না মিঃ সেঙ্গার! একটু
সবিস্তারেই বলবেন।"
মিঃ সেঙ্গার এ অনুরোধে প্রথমটা
যেন থতমত খেলেন। এ কামরার মধ্যে এবার বেশ কাছে থেকে মিঃ সেঙ্গারকে
তখন লক্ষ্য করবার সুযোগ পেয়েছি। ওপরের ফিটফাট পালিশ করা চেহারা
সত্ত্বেও লোকটিকে কি একটা কারণে যেন অত্যন্ত বিব্রত মনে হল। কারণটা
এর পরই তাঁর কথায় বুঝতে বাকি রইল না। মিঃ সেঙ্গার কিছুটা মুখস্থ
আওড়াবার মত যা বলে গেলেন, তাতে জানা গেল, আগের দিন রাত্রে বারোহা
এই হোটেলের রেস্তোঁরায় আর কয়েকজন বোর্ডারকে নিয়ে একটা ছোট পার্টিতে
যোগ দিয়েছিল। পার্টিতে বারোহা বাদে ছিল ফরাসী প্রৌঢ় মঁসিয়ে রেনোয়া।
তাঁর ভাগনী জিনেৎ আর এলসা। পার্টিতে আহার যতটা তার চেয়ে পানটা
একটু বেশীই সাধারণতঃ হয়ে হাকে, কিন্তু রেস্তোরাঁর বারের হিসেব
থেকে জানা গেছে সেরকম কিছু একেবারেই হয় নি। বারোহা ব্রাণ্ডির ভক্ত,
গত রাত্রে তাও সে গোণাগুণতি কয়েকটি পাত্র মাত্র খেয়েছে। মঁসিয়ে
রেনোয়া, মাদমোয়াজল জিনেৎ আর এলসাও তাই। মঁসিয়ে রেনোয়া কিছুক্ষণ
পার্টিতে থাকবার পরে শরীর খারাপ বলে বিদায় নিয়ে গেছেন। পার্টিও
তারপর বেশীক্ষণ চলেনি। ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই সবাই যে যার কামরায়
চলে গিযেছেন। কিন্তু তারপর, মানে, রাত্রি থেকেই এঁদের অসুস্থতা
শুরু হয়েছে।
প্রথমে রিসেপশন কাউণ্টারে 'কল' এসেছে
মঁসিয়ে রেনোয়ার কাছ থেকে। তিনি নিজে অত্যন্ত অসুথ বোধ করছেন। কিন্তু
নিজের চেয় বেশী ভাবিত হয়েছেন তাঁর ভাগনী জিনেতের জন্যে। কিছুক্ষণ
আগে তাঁর হঠাৎ গলাটা যেন কেউ চেপে ধরেছে এই রকম বোধ হবার সঙ্গে
মাথাটা বড় বেশী ঝিম-ঝিম করছে মনে হয়। হয়ত প্রেসার বেড়েছে মনে করে
তার ওষুধ খুঁজে না পেয়ে তিনি পাশের ঘরের জিনেৎকে ফোন করেন। জিনেতের
ঘুম নাকি খুব পাতলা। তবু আট-দশ মিনিট ধরে ফোন করে সাহায্য চান।
ইমার্জেন্সির সাহায্য আসবার আগেই জিনেৎ-এর সাড়া অবশ্য তিনি পান।
কোন রকমে ফোন ধরে সে তার বুকের কষ্ট আর গভীর আচ্ছন্ন ভাবের কথা
বলে। মঁসিয়ে রেনোয়া তার দরজায় গিয়ে দাঁড়াবার পর কোনরকমে দরজাটাও
খুলে দিতে পারে তখন।
মঁসিয়ে রেনোয়া ইমার্জেন্সীতে ফোন করায়
মিনিট খনেকের মধ্যেই রিসেপশনে মিঃ বারোহার ফোন আসে, তখনই একজন
ডাক্তার পাওয়া যাবে কি না জানবার জন্যে। এ ফোন পেয়ে রিসেপশনের
স্টাফ যে অত্যন্ত বিচলিত হয়ে ওঠে তা বলাই বাহুল্য। মিঃ সেঙ্গারকে
তৎক্ষণাৎ তারা ফোন করে জাগিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা জানায়। মিঃ সেঙ্গার
অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে তখনই হোটেলে চলে এলেও ব্যাপারটা নিয়ে বেশ একটু
মুস্কিলে পড়েন। মঁসিয়ে রেনোয়া তখন অবশ্য ফোনে জানিয়ে দিয়েছেন যে,
তাঁর ভাগনী ইতিমধ্যে অনেকটা সুস্থবোধ করছে বলে তাঁর জন্যে কোনো
ডাক্তার পাঠাবার আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু অসল দুর্ভাবনা হয়েছে মিঃ
বারোহাকে নিয়ে। মিঃ বারোহা সেই একবার ডাক্তারের জন্যে ফোন করার
পর একেবারে চুপ হয়ে গেছেন। বার বার তাঁর ঘরে রিং করেও কোনো সাড়া
তাঁর কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি যেন একবার ফোন করেই ঘুমিয়ে
পড়েছেন মনে হয়। ঘুমিয়ে পড়ার বদলে অজ্ঞান হওয়ার সম্ভাবনাও যে থাকতে
পারে সে কথা ভেবেই ম্যানেজার তখন অত্যন্ত অস্থির হয়ে উঠেছেন।
এই পর্যন্ত শুনেই বারোহা
একটু যেন লজ্জিতভাবে বাধা দিয়ে বললেন, "অজ্ঞানই কি হয়ে গিযেছিলাম?
কে জানে! আমার কিন্তু রিসেপশনে ফোন করার কথাও কিছু মনে নেই।"
ম্যানেজারকেতার পর
একটু আশ্বাস দেবার চেষ্টা করলে বারোহা, "যাইহোক, আমি যখন
আর সাড়াশব্দ করিনি থখন আমার ফোনটা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমের ঘোরেই
করা বুঝেই নিশ্চিন্ত হতে পারতেন।"
"তা কি পারি!"
ম্যানেজা একটু ক্ষুভ স্বরেই প্রতিবাদ জানালেন, "আপনার বিষয়ে
কি করা উচিত, সেইটেই তখন দারুণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িযেছিল। আপনি সত্যি
অসুস্থ হলে যথাসাধ্য চিকিৎসা আর শুশ্রুষার ব্যবস্থা আমাদের না
করলে নয়। অথচ আমাদের কোনো বোর্ডারকে মাঝরাতে বিনা কারণে জাগিয়ে
বিরক্ত করার অধিকার আমাদের নেই। তবু মঁসিয়ে রেনোয়াও নিজের আর তার
ভাগনীর অসুস্থ হওয়ার কথা জানিয়েছেন বলে ব্যাপারটা স্বাভাবিক কিছু
নয় বলেই ধরে নিতে বাধ্য হলাম। আপনাদের সম্বন্ধে হোটেলের দায়িত্ব
খাবার আর পানীয় নিয়ে। খোঁজ নিয়ে জানলাম আপনারা যা খেয়েছেন, তা
একেবারে সন্দেহাতীতভাবে নিরাপদ নির্দোষ খাবার, কারণ সমস্ত হোটেলেই
সেই এক খাবার পরিবেশিত হয়েছে আর তাতে বিন্দুমাত্র কুফল কারুর হয়নি।"
"খাবার না হলে
দোষ কি তাহলে পানীয়ের?"
"সে সম্ভাবনাটা
মাথায় এলেও আমল একরকম দিইনি বললেই হয়। আমাদের হোটেলের চেয়ে বিশুদ্দ্ব
একেবারে সর্বশ্রেষ্ঠ পানীয় দেশবিদেশের সেরা হোটেলের পক্ষেও দেওয়া
সম্ভব নয়, কারণ এ হোটেলে প্রথম শ্রেণীর জিনিষ ছাড়া নিরেস কিছু
এক ফোঁটাও কখনো আসে না।"
"তাহলে কি মাত্রার
বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে?"
"সত্যি কথা স্বীকার
করছি, মিঃ বর্মা ভোর রাত্রে একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে আমায় ফোন
করার আগে ওদিক দিয়ে কিছু ভাবিইনি।"
"মিঃ বর্মা ভোরবেলা
আপনাকে ফোন করেছিলেন? উনি হোটেলের এ ব্যাপারের কথা জানলেন কি করে?"
আমার বিস্মিত প্রশ্নটাই বারোহার মুখ দিয়ে বার হল।
“হ্যাঁ!" ম্যানেজার
বিমূঢ় মুখেই স্বীকার করলেন, "ওঁর ফোন পেয়ে আমি ঐ কথা ভেবেই
বেশী হতভম্ব হয়েছি। প্রথমে অবশ্য অধিকারের বাইরে এরকম নাক গলাবার
স্পর্ধার জন্যে ওঁকে জাহান্নমে বলার ইচ্ছেই হয়েছিল। কিন্তু শেষ
অবধি ওঁর যুক্তি শুনে ওঁর প্রস্তাবে রাজী না হয়ে পারিনি।"
"কি যুক্তি দিয়েছেন
মিঃ বর্মা! আর কি প্রস্তাব করেছেন?" এবারও আমার কৌতূহলটাই
প্রকাশ করলে বারোহা।
আমাদের মত হোটেলের
সুনামের পক্ষে এরকম ঘটনা যে অত্যন্ত সর্বনাশ ক্ষতিকর, আর তার মূলে
কি আছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুঁজে বার করে সে জট যে নিঃশব্দে এখনি
সরিয়ে ফেলা দরকার, তা জানিয়ে উনি আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছেন।
"সে-সাহায্য আপনার
পক্ষে প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব নয়, বুঝতে পারছি," নিজের অসুস্থতা
যেন ভুলে গিয়ে একটু হেসে উঠে বললেন বারোহা। "কিন্তু এখনো
সেই প্রশ্নটাই উত্তর পাওয়া গেল না। মিঃ বর্মা হোটেলের ও ব্যাপারের
কথা রাত না পোহাতে জানলেন কি করে? হোটেলের অন্য কোন বোর্ডারও ত
এখনো এ বিষয়ে বোধহয় কিছু জানে না।"
"তা ত জানেই না।"
ম্যানেজার বললেন, "তবু মিঃ বর্মা কেমন করে হোটেলের বাইরে
থেকে এ খবর পেলেন উনি আসামাত্র আমি জিজ্ঞাসা করেছি। তাতে উনি যা
উত্তর দিয়েছেন ওঁর মুখেই শুনুন।"
"সত্যি রহস্যটা
কি তা বলবেন মিঃ বর্মা।" জিজ্ঞাসা করলে বারোহা।
আগের অংশ পরের
অংশ
প্রেমেন্দ্র
মিত্র
প্রেমেন্দ্র
মিত্রঃ জন্ম ১৯০৪; মৃত্যু ১৯৮৮। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক
ও চলচ্চিত্রকার । ১৪-টি চলচ্চিত্রের পরিচালক, চিত্রনাট্য লিখেছেন
অজস্র। ‘সাগর থেকে ফেরা’ কাব্যগ্রন্থ লিখে পান আকাদেমি পুরস্কার
ও রবীন্দ্রপুরস্কার। বাংলা ভাষায় সায়েন্স ফিকশনকে সাহিত্যের মর্যাদা
তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন ঘনাদাকে সৃষ্টি করে। গোয়েন্দা সাহিত্যর
ওঁর অবদান পরাশর বর্মা। পরাশর বর্মার বই মূলতঃ বড়দের জন্যে লেখা,
তাই কিশোরদের গোয়েন্দাকাহিনী সংগ্রহে পরাশর বর্মাকে চোখে পড়ে না।
‘প্রেমের প্রান্তে পরাশর’ উপন্যাসটি এ. মুখার্জী এণ্ড কোং প্রকাশিত
‘পরাশর সমগ্র’ থেকে নেওয়া। এটি এখানে ছাপানোর অনুমতি দিয়ে তার
কর্ণধার রঞ্জন সেনগুপ্ত আমাদের বাধিত করেছেন।