সোনার বিষ্ণুমূর্তি
২
আমরা রাত একটার সময় একটা
সাদা ইনোভা গাড়িতে জিনিষপত্র নিয়ে উঠে বসলুম। গাড়িটা পুলিশের।
চালক ও প্লেনড্রেস পুলিশ একজন। এ’তে না কি টোল ট্যাক্স দিতেই হবে
না হাইওয়েতে উঠলেও।
চঞ্চল চোখে রোদ চশমা লাগিয়ে
আর সেই লাঠিটা হাতে নিয়ে এক প্রতিবন্ধী ছেলে আর আমি মাথায় গামছা
বেঁধে পুরণো পোষাক পরে ফাই ফরমায়েস খাটা চাকর সেজেছি। চঞ্চলের
চশমাটায় নাইট ভিজন ব্যবস্থা আছে। রাতে ও দেখতে অসুবিধা হবে না।
লাঠিটাকে আমি সাদা রং করে নিয়েছি চট করে।
কাকু, চঞ্চলকে সাহায্য করবার
দায়িত্বই শুধু আমাকে দেয় নি, অপরূপ সুন্দর পরীর দেশের রাজকুমার
ছেলেটার ভার ও আমার হাতে দিয়েছে। কাকু, সামনের সীটে আর আমি চঞ্চলকে
নিয়ে পেছনের চওড়া নরম কভারওয়ালা সীটে বসেছি। ঘুমের দরকার হ’লে
চঞ্চলকে শুইয়ে দেব সীটেতে। নিজে ও শুয়ে পড়তে পারব।
অনেক জায়গা আছে । তবে এই সব জামাকাপড় পরে শুয়ে ঘুম ভালো হবেই না
ট্রেনের মতন, তা ঠিক।
আমাদের গাড়ী ছেড়ে দিলো।
আবার কাশীর গঙ্গা পার হ’তে
হ’বে মালবীয় সেতু দিয়ে।
ট্রেনে অন্তত বসে লুডো খেলা
ও যায়, চঞ্চলের সাথে। এই গাড়িতে সে’গুড়েও বালি। মহা মুশ্কিল আমার।
কমিক্স যে পড়ব বসে, তা আলো কই? যাচ্ছেতাই কান্ড। চঞ্চল অবশ্য শুয়ে
পড়লো একটু পরেই। আমার ঘুম আসছে না। কাকু ও ঠায় বসে আছে। কি ভাবছে
কে জানে। আমি কাকুকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো ভাবছিলুম।
একঘন্টা কাটল।
আমরা নক্সাল প্রভাবিত এলাকায়
এসে গেছি বলে মনে হয়। ড্রাইভার আংকল খুব সাবধানে গাড়ী চালাচ্ছিলেন
তাই হয়তো।
সামনে একটা কোন সেতু আসছে
মনে হ’লো। দু’পাশে সাদা রেলিং পড়তে শুরু করেছে।
হঠাৎ দেখি রাস্তার মাঝখানে
একটা লোক হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দেহাতী লোক বলে মনে হয়। গামছায়
তার মুখ ঢাকা। সে মনে হয় আমাদের গাড়ী থামাতে চাইছে। কিছু ব্যাপার
হবে। হয়তো সাহায্য চাই নয়তো ডাকাত ও হতে পারে। কাকু, রিভালবার
বার করছে। দেখাদেখি ড্রাইভার আংকল ও পকেটে বাঁ হাত ঢুকিয়ে ব্রেকে
চাপ দিয়েছে। গাড়ী থেমে আসছে।
আমি ঘুমন্ত চঞ্চলকে আড়াল
করে বসে জানলার কাঁচ অল্প খুলে লাঠিটা হাতে নিয়ে তৈরী হলুম।
‘কে? কি চাই’?
‘ইধার কঁহা যানা হ্যায়? সাথ
মে বাল বাচ্চে কো লেকর কঁহা যা রহে হো?’
‘নৌগড়’
‘পিছে সে আউর এক রাস্তা হ্যায়।
ঘুম কে চলা যাও। ইধার সে নহি’।
‘কেঁও?’
‘তখনি পিছনে জাগল কোঁ কোঁ
করে সাইরেন ধ্বনি। আর লোকটা তা শুনেই উত্তর না দিয়ে এক লাফ মেরে
সেতু থেকে নেমে পড়ে দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। বেশ মজার কান্ড
তো।
হয়তো পুলিশ জীপ আসছে একটা
নির্ঘাৎ।
তবে রাত পাহারার ব্যবস্থা
সত্যিই করা হয়েছে দেখছি। কাকু ভূল বলেনি তখন।
তা এখন কাকুই কিন্তু বললো-‘দিবাকর, জল্দিসে গাড়ী ব্যাক করো। কঁহি
কুছ গড়বড় জরুর হ্যায়। যানে সে পহলে চেক করনা হোগা’।
আমাদের গাড়ী ব্যাক করে মুখ
ঘুরিয়ে নিলো উল্টোদিকে আবার।
‘আভি য়ঁহা সে দূর লে চলো
গাড়ী কো। কম সে কম পাঁচশো মিটার। ফির উতরকে আনা হোগা পয়দল চল কর’….
কাকুর নির্দেশে গাড়ী এগিয়ে
চললো। সেতুর সাদা রেলিং শেষ হ’তে আমাদের গাড়ী গিয়ে পথের বাঁ পাশ
ঘেঁসে থামলো। আমাদের পাশ দিয়ে তখনি একটা গাঢ় নীল রঙের পুলিশ জীপ
ছুটে চলে গেল আমাদের দিকে ফিরে ও না তাকিয়ে।
দরজা খুলে কাকু নেমে পড়ে
বললো-‘জীপটা তো সেতু তে উঠবে। আমাদের বারন করলো েন তা কে জানে।
আরে দিবাকর। তুমি আবার নামলে কেন নীচে? আমি একলাই যেতে পারবো।
তুমি দরজা খোলা রাখবে না একদম। বন্ধ করো। গাড়িতে এ০সি০ চলছে না?’
বলেই কাকু রিভালবারটা পকেটে
ফেলে রুমাল বার করে দু’কানে জড়িয়ে বাঁধতে শুরু করে আমার দিকে চেয়ে
বলল-‘তুমি কাঁচ বন্ধ করো, বাদল। আরে….কি সর্বনাশ…ও কিসের আলো?’
এই রে, সদা সতর্ক কাকু ঠিক
দেখে ফেলেছে।
ভয়ে আমি কাচ বন্ধ করছি হঠাৎ শুনি দারুণ জোরে এক বিস্ফোরণের শব্দ।
….গুড়ুম …হুড়ুম …দড়াম… ধাঁই….করে বিষম এক শব্দঝন্ঝনা। কাকু ততক্ষনে
মাটিতে শুয়ে পড়েছে। দিবাকর আংকল ছিটকে পড়েছে আর দূরে যেন কেউ তুবড়ি
জ্বালিয়ে দিয়েছে একসাথে এক ডজন। আলোয় আলো চারদিক। সেই আলোর লাল
বৃত্তের মাঝে দেখলুম যে শূন্যে একটা পাখি যেন উড়ে নেমে যাচ্ছে
নিচের দিকে।
মনে হ’লো কয়েকজন লোক আর্তনাদ
ও করছে যেন। কাচ বন্ধ তাই ঠিক শোনা গেলো না।
গাড়ির ভেতরে ও জোর ঝটকা লাগলো
আমাদের। চঞ্চল জেগে উঠে বললো-‘বাদল, কি হয়েছে? গাড়ী দুর্ঘটনা?
কাকু কোথায়?’
আমি বললুম-‘সেতু দুর্ঘটনা।
মাইন বিস্ফোরণ ও হ’তে পারে। ও মাই গড, পাখিটা তবে সেই পু…’
‘কোন পাখি?’
‘বলবো। দাঁড়া’।
গাড়ির বাঁ পাশের দরজা খুলে
বললুম-‘ও কাকু, আমি আসছি। ড্রাইভার আংকল কি চোট পেয়েছে?’
বাইরে থেকে কাকু বললো-‘পড়ে
গিয়েছে। বিস্ফোরণের আগে সময়মতো মাটিতে শুয়ে না পড়লে এই হয়। এখন
চোখেমুখে জল দিয়ে হাওয়া করে তুলে শোয়াতে হবে ব্যাক সীটে। তোমরা
নেমে এসে সামনে বোসো। আমাকেই এখন ড্রাইভ ও করতে হবে। রাস্তাও তো
চিনিনা ছাই। আগে ব্যাক করি তো খানিকটা’।
আমি নেমে চঞ্চলকে সামনের
সীটে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করলুম সামনের তারপর পিছনের
সীট থেকে ওয়াটার বটল নিয়ে এসে কাজ শুরু করলুম কাকুর কথামতন।
গাড়ী চললো মিনিট দশেক পরে।
পেছনে পড়ে রইলো আধভাঙা সেতু আর অনেক নিচে ঝোপঝাড়ের মধ্যে বা নদীর
জলের মধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত পুলিশ জীপ। নক্সালপন্থিদের ধ্বংসের চিহ্ন।
নীচে নদী না রাস্তা না রেল লাইন কি যে আছে কে জানে? আমরা একটুর
জন্যে বেঁচে গিয়েছি মনে হ’লো।
ড্রাইভার আংকল সুস্থ হয়ে
উঠলো আধঘন্টা পরে।
তবু ও তার নির্দেশে কাকুই চালাতে রইলো গাড়ী। আমি বললুম-‘কাকু,
একটা কথা জিজ্ঞাসা করি তোমাকে?’
কাকু ড্রাইভিং করতে করতেই
বাঁ হাত তুলে আমাকে জড়িয়ে ধরে একদম নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে
বললো-‘বলো, বাদল’।
আমি বুঝলুম যে কাকু একটু
সাবধান হ’তে চাইছে এখন তাই আমি ও ড্রাইভার আংকল বা চঞ্চল কেউ না
শুনতে পায় এমনিভাবে বললুম-‘তটবন কি রকমের বন, বলো না, কাকু?’
‘দন্ডক বন, খান্ডব বন অনেক
সব বনই তো ছিল আগে মহাভারতের কালে তা তো শুনেছি। এখন ও কিছু কিছু
আছে টিঁকে হয়তো, কিন্তু তটবন ? সমুদ্রতটের বা নদীতটের বন কি? নাঃ
, এ ঠিক হচ্ছে না … আচ্ছা বাদল, কথাটা কি কোন বাঙালির মুখে তুমি
শুনেছো?’
‘না কাকু, একজন হিন্দীভাষীর
মুখের কথা’।
‘এই রে, তা’হলে তো কথাটায়
বন মানে জঙ্গল না ও হ‘তে পারে, বাদল। অন্য অর্থে প্রয়োগ করা হতেই
পারে শব্দটা। আগে ল্যাক্টো বন বন নামে কিন্তু একটা চকোলেট ছিল।
বেশ ভালো খেতে। পাঁউরুটি ও হয় একটা ওই নামের। মিষ্টিমতন বেশ লাগে’।
আমি হেসে ফেলে বললুম -‘কাকু,
তোমাকে ধন্যবাদ । শুনেই তো খেতে ইচ্ছে করছে আমার। কিন্তু আমি এইবার
বুঝতে পারছি মানেটা একটু একটু করে। তবে পরীক্ষা প্রার্থনীয়, কাকু….
হিঃ…হিঃ…হিঃ…’
কাকু চুপ। কি মানে জানতে
চাইলো না।
আমরা শেষ রাতে যথাস্থানে হাজির হয়ে গ্রামের একটা ঝোপড়ি মতন বাড়ির
সামনে গিয়ে দাঁড়ালুম।
নৌগড় বাজার থেকে জায়গাটা
না কী অনেকটা ভেতরে। গ্রামের মধ্যে।
সেখানে লাইট ও নেই। নিঃঝুম ঘোর অন্ধকার রাত। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে জোর।
তবে একজন চৌকিদার ছিল। সে ডাকাডাকিতে উঠে বেরিয়ে এসে ঘুম চোখে
গেট খুললো। কাঠের আগড় বলাই ভালো সেই গেটকে। ঘর ও খুলে দিলো সে
একটা। মাত্র শিকল তোলা ছিল। তালা টালার বালাই নেই। এই রকম ব্যবস্থায়
চুরী হবে না তো কি হবে? কেমন লোক রে বাবা এরা সব?
ঘরে মাত্র একখানা খাটিয়ায়
একটা কম্বল পাতা আছে বটে কিন্তু টেবিল চেয়ারের বালাই না থাকলে
ও একটা বালতি ও মগ রয়েছে। জল সমেত। একটা হ্যারিকেন ও সে জ্বেলে
এনে দিতে তবে সব কিছু ঠিক করে দেখা গেল। একটা অন্য খাটিয়া ও এনে
পাতলো সে লোক বেশী দেখে। ড্রাইভার আংকল একটা অন্য ঘর পেলো।
কাকু ব্যাগ থেকে টর্চ বার
করতে করতে মৃদুস্বরে বললো –‘জায়গাটা খুব সুবিধের নয় বলে মনে হচ্ছে,
বাদল। তটবন না হ’লে ও এমনি বন তো থাকতেই পারে আে পাশে। এ’ হচ্ছে
এক অজ গ্রাম। নৌগড় বাজার থেকে খানিক দূরে। কল টল ও নেই। জলের জন্য
একটা কুয়ো থাকলেও আছে। বাথরুম যে নেই আমি সিওর। তার মানে বুঝছো
কিছু, বাদল?’
আমি শুনেই খিল খিল করে হেসে
দিতে সুন্দর ভ্রুজোড়া ধনুকের মতন করে কুঁচকে রূপবান ছেলে চঞ্চল
বললো-‘হঠাৎ হাসির কি হ’লো, বাদল?’
‘সকাল হ’লে বুঝতে পারবি নিজেই,
যখন কাকু না, তোকে একদম ল্যাংট করে ওপেন এয়ার বাথরুমে নিয়ে যাবে
প্রাতঃকৃত্য সারতে ও কুয়োতলায় চান করাতে…হিঃ হিঃ হিঃ ’
‘এ মা গো ছিঃ……কি সব কথা?
কাকু, এই ভীষণ দুষ্টু ছেলে বাদলটা মিথ্যে কথা বলছে আমাকে ঠাট্টা
করবার জন্য, তাই না কাকু?’
‘বাদল তোমাকে তো ঠাট্টা করতেই
পারে কিন্তু মিথ্যে কথা ওই সুন্দর ছেলেটা যে বলে না, চঞ্চল’।
‘সর্বনাশ…..তার মানে, কাকু?’
‘মানে এই যে এখন একঘন্টার
মতন বিশ্রাম করা যেতেই পারে অনায়াসে তবে প্রাতঃকৃত্য সারতে হবে
আমাদের এ’খানে ব্রাম্হমূহুর্তে, তা ঠিক। বাদল পাহারা দেবে আগে।
কুকুর বা শিয়াল টিয়াল তো থাকতেই পারে মাঠে। তোমাকে আগে স্নান ও
করিয়ে দিয়ে তারপরে বাদলকে নিয়ে যাবো না হয়’।
‘মা ভৈঃ চঞ্চল, আমি কিন্তু
সঙ্গে তোয়ালে এনেছি আলাদা করে। তাই তোমাকে বা বাদলকে ঠিক আক্ষরিক
অর্থে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে প্রাতঃকৃত্য বা স্নান কোনটাই করতে হবে
না কিন্তু খালি গায়ে কুয়োতলার খোলা জায়গায় স্নান করা ললাটের লিখন
এই সব গ্রামে। অবশ্য গ্রামে দেখতেই পাবে যে তোমাদের চেয়ে অনেক
বড় বড়, এমনকি ১৬ কি ১৭ বছরের সব ছেলেরা ও দিব্যি পুকুর বা তালাওয়ে
অনায়াসে একদম ল্যাংট হয়ে দিন দুপুরে স্নান করছে ও সাঁতার কাটছে’।
‘এ রাম ছিঃ…অতো বড় বড় ছেলেদের
ও তবে লজ্জা বলে কিচ্ছু নেই। নাঃ, এই অসভ্য গ্রামে আমি থাকতে চাই
না কাকু। তা বলোতো কতোদিন লাগতে পারে তোমার, কাকু’?
‘তা তো এখনি ঠিক করে বলতে
পারছি না, ভাই। এসো একটু গড়িয়ে নেওয়া যাক তবে ইনি হ’লেন খাটিয়া।
খাট তো নয় যে শোওয়া যাবে ভলো করে। শুয়েই দেখ না মজাটা। গড়িয়ে মাঝখানে
চলে যেতে হবে তোমাকে। আর ছারপোকা তো থাকতেই পারে…..’।
তা সেই মতনই সব কাজ সেরে
আমাদের তৈরি হ’তে হ’লো।
কাঁচা ভিজে ছোলা ও দুধ দিয়ে জলযোগ সারতে হ’লো গ্রামের দারোগার
ব্যবস্থায়।
কি আর করা? শেষে চঞ্চল প্রতিবন্ধী সেজে লাঠি হাতে ও আমি চাকর হয়ে
মাথায় গামছা জড়িয়ে রওনা হয়ে পড়লুম।
দিন ভোর আমাদের রোদ্দূরে
ঘুরে বেড়াতে হ’লো। সবাই কার কি চুরি গেছে, তার লম্বা লিষ্ট হাতে
নিয়ে এসে কাকুকে জ্বালিয়ে মারতে শুরু করলো। হাতে হাতে চোর ধরেও
বামাল ধরা না পড়ায় পুলিশকেও চোরদের ছেড়ে দিতে হয়েছে কখন আর কি
ভাবে, সেই সব ধারাভষ্য শুনতে শুনতে আমরা অস্থির।
দেহাতী ভাষায় কাঁদুনি গাওয়া
আর থামেই না। মহিলাদের তো কথাই নেই ।
এককথায় বলতে হয় যে শুরু তো
আছে কিন্তু সেই সব অভিযোগের কোন শেষ নেই । অর্ধেক কথা তো বোঝাই
দায়। ধন্যি বাবা কাকুর ধৈর্য। একটু ও রাগলো না, কাকু। সব লিষ্ট
নিলো। অভিযোগ শুনলো। নোট ও করলো কিছু কিছু। শেষে গড়ের মন্দিরে
গেল। সেই মন্দিরে তখন দেবতা নেই। তাই বলতে বলতে পূজারি বামুনের
কান্না আর থামেই না।
দুপুরে গ্রাম প্রধানের বাড়িতে
মধ্যাহ্ন ভোজনের ব্যবস্থা ছিলো।
শুদ্ধ দেশী খানা। ডাল, দেশী
ঘি লাগানো মোটা মোটা চাপাটি আর আলুর ভাজি। বাটি চোখা অর্থাৎ লিট্টি
আর বেগুন আলু পোড়া খাবার নিমন্ত্রন কালকের জন্য দিয়ে ও দেওয়া হ’লো।
এইসব খাবার দিন কয়েক খেলে যে আর দেখতে হবে না, আমাদের তা ঠিক মনে
হ’লো।
তবে গ্রামের অভিজ্ঞতা ও বেশ
মজার। যদি ও চঞ্চলের কিচ্ছুটি সে’খানের পছন্দ নয়, তার আর কি করা
যাবে? এরই মধ্যে এই বয়সে চঞ্চলের মতন সুন্দর বাবুয়া কি করে প্রতিবন্ধী
হ’লো তা ও অনেকে জানতে চেয়েছে, কাকুর কাছে বেশ দরদ দেখিয়ে। চঞ্চল
সেই সমস্ত কথা শুনলে তো। আমি ঠিক শুনেছি । কাকু বলেছে উপরবালে
কি মর্জি, ভাই।
মোটকথা এই সব গ্রামেতে সুবিধার
অনেক অভাব আছে ঠিকই কিন্তু লোকগুলো শহুরেদের মতন কুচুটে নয়। চোর
ডাকাতের কথা তো আলাদা। তারা নেই কোথায়?
সে যাক। বিকেলে আমাদের দু’কোশ
দূরে থানায় যেতে হ’লো। গ্রামের কাঁচা অসমতল রাস্তায় গাড়ী না থাকলে
সাইকেল বা বৈলগাড়ী ভরসা।
দারোগা মিঃ দুবে একখানা কাগজ
হাতে নিয়ে মুখ শুকিয়ে বসে ছিলেন একটা কালোমতন টেবিলের পিছনে নিজের
পুরোণো কাঠের চেয়ারে। অন্য হাত মাথায়। কি না, উপর থেকে রিজার্ভ
ফোর্স আসছে কাল। সব চোর ধরা পড়া চাই তিনদিনের মধ্যে আর চোরাই মাল
ও উদ্ধার হওয়া চাই।
বুঝলুম কালকের সেতুভঙ্গ আর
পুলিশ জীপের উড়ে যাওয়ার ফল।
কিন্তু কাকু চুপ।
কাল আবার দেখা হবে বলে সোজা
বাড়ী ফিরে এসে খাটিয়াতে গিয়ে ঝপ করে শুয়ে পড়লো চঞ্চলকে নিয়ে। কাকু,
কোন সূত্রই পায়নি, বোঝা গেল। আম্মো পাইনি তখন ও কিচ্ছুটি বুঝতে।
চঞ্চল বললো—‘কাকু, গাড়ি চললে
যা ধূলো ওড়ে না কাঁচা রাস্তায়। কাচ তো বন্ধ কিন্তু আমার তো গা
হাত পা কর কর করছে। আর তেমনি গরম ও লাগছে। কাকু, চান করা গেলে
ভালো হতো’।
শুনে ও কাকু উঠলো না শুধু
বললো—‘সন্ধ্যে হোক’।
তা সন্ধ্যের পরেই দেখি কাকু
গিয়ে নিজেই কুয়ো থেকে জল তুলে চঞ্চলের দুধ সাদা হাত ধরে নিয়ে গিয়ে
দামী সাবান মাখিয়ে চান করাবার পরে অন্য পরিষ্কার ড্রেস পরিয়ে দিয়ে
ঘরে এনে বসিয়ে রেখে আমার ও হাত ধরে নিয়ে গিয়ে চান করাতে চললো।
আমি বললুম-‘কাকু, এই এলাকাটা
কাল আমাদের কিন্তু একবার পুরো ঘুরে দেখতে হবে। পুলিশ ফোর্স কখন
আসবে, কাকু?’
‘মনে হয় সন্ধ্যাবেলায়। এইরকম
সময়ে’, কাকু বললো।
মুখ ধু’তে গিয়ে কুয়োর জলটা
বেশ মিষ্টিমতন লাগলো আমার। অনেকটা যেন নদীর জলের মতন। কেন মনে
হ’লো তা ঠিক বুঝলুম না। তবে চান করে বেশ ঠান্ডা আর ঝরঝরে লাগছিলো।
কাকু আমার তোয়ালেটা খুলে
নিয়ে কেচে নিংড়ে আমার মাথা গা হাত পা সব ভালো করে মুছিয়ে দিতে
দিতে অন্যমনস্কভাবে বললো-‘রাতে ও আজ ডাল রুটিই ভরসা। দুধ হয়তো
পাওয়া যাবে। চঞ্চলের খুব কষ্ট হবেই। কাল আবার বরাতে লিট্টিপোড়া
নাচছে। কি যে করি?’
শুনে আমি খিল খিল করে হেসে
দিলুম।
কাকু আমার পরিষ্কার জামা
প্যান্ট অ্যাটাচী থেকে বার করে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলো। টর্চ ও। আমাকে
আর ঘরে না নিয়ে গিয়ে সেই খানেই বসে কাকু আমার গায়ে ঠান্ডা পাউডার
মানে ঘামাচির পাউডার মাখিয়ে দিলো আর শেষে গেন্জী আর জামা টামা
ও সব পরিয়ে দিতে শুরু করলো দেখে আমি বললুম-‘আচ্ছা কাকুউ, এইখানে
কোন নদী আছে? কুয়োর জলটা যেন নদীর মতন মিষ্টি, না কাকু?’
কাকু বললো-‘না নেই। তবে কোন
ফল্গু নদী থাকলে বলা কঠিন’।
তারপরে টর্চটা আমার হাতে
দিয়ে বললো-‘বাদল, আমি ও নেয়ে নিই এইবারে । লন্ঠনের আলোতে তোমরা
তারপরে ঘরে বসে না হয় লুডো খেলে নিও খানিক। খাবার আসতে রাত আটটা
তো বাজবেই’।
আমি তখন কাকুর ফল্গু শব্দটার
মানে খুঁজছি মনে মনে। মনে পড়ি পড়ি করে ও মনে পড়ছে না কিছুতেই।
কাকুকে ও জিজ্ঞাসা করতে লজ্জা করছে।
লুডো খেলতে বসে অন্যমনস্ক
থেকে ভূল চাল দিয়ে চঞ্চলের কাছে একদান গো হারান হারবার পরে মনে
পড়ল মানেটা….. অন্তঃসলিলা। বুঝলুম যে আমি জিনিয়াস ছেলে না ছাই।
ও’সব কাকুর আদিখ্যেতার কথা।
ততক্ষনে আমাদের জন্য ডাল
আর রুটি এসে হাজির।
কাকু খেয়ে উঠে চঞ্চলকে নিয়ে
খাটিয়ায় শুয়ে পড়বার আগে আমার জামা প্যান্ট খুলে অন্তর্বাসের ওপরে
পাতলা নাইট গাউন পরিয়ে দিয়ে আমাকে খুব খানিকটা আদর করে নিলো। চঞ্চলের
ডাল রু তখন ছেলে। চঞ্চলটা ভারী ফুড সেন্সেটিভ ছেলে হয়েছে, অন্য
কোন দিকে হুঁশই নেই। এ’টা কি আমাদের বাড়ী না কী?
আমি অন্য খাটিয়ায় চিৎ হয়ে
শুয়ে পড়ে ভাবলুম রাতে আবার সেই ছেলেধরা ডাকাতগুলো না আসে। আসতেই
পারে। পাহারার তো বালাই নেই। তাই মে হয় যে
তাদের ভয়ে রাতে আমার ভাগ্যে ঘুম নেই লেখা। কাকুরা ঘুমিয়ে পড়লে
তখন না হয়
খানিকপরে দু’চোখের পাতা বেশ
ভারীমতন লাগতে দুত্তোর ঘুমের না নিকুচি করেছে বলে উঠে পড়লুম আমি।
বড় গোলাপী ড্রেসিংগাউনটা
আমার পক্ষে বেশ অসুবিধাজনক বলে খুলে রেখে তালাটা বার করলুম কাকুর
ব্যাগ থেকে। ঘরটা একদুয়ারী বলে তালাটা শুধু সুরষোতে পরিয়ে আটকে
দিলুম আগে। কেউ না শিকল তুলে আটকে দিতে পারে দরজাটা বাইরে থেকে।
সঙ্গে একটা পাতলা পলিথিনের টুকরো ছিল। সেটা জানলার গ্রিলের গায়ে
ভেতর থেকে টেপ দিয়ে আটকে দিলুম যাতে চট করে কিছু না ঢুকে পড়ে ঘরে।
আমার ছোট্ট এল০ই০ডি০ টর্চ
জ্বেলে দেখলাম ঘরের এক কোনে বেশ বড় একটা মাটির জালা বা কুন্ডা
রয়েছে। সেটাকে তুলে নিয়ে এসে বাইরে দাওয়ার এক ধারে বসালুম। এইবার
চাই জল। দড়ি বালতি নিয়ে গিয়ে কুয়ো থেকে কাকুর মতন করে জল তুলে
এনে জালাটায় ভরতে শুরু করে দিলুম।
শেষে ঘরে আর না থেকে দাওয়ায়
জালাটার আড়ালে গিয়ে বসে রইলুম আমি। দেখাই যাক আমার অনুমান সত্যি
হয় কি না।
কিন্তু হঠাৎ আমার পেটে দারুণ ব্যথা করতে শুরু হয়ে গেলো।
কুয়ো থেকে জল তুলেছি বলে
তো মনে হয় না পেটে এতো ব্যথা করছে। সন্দেহ হ’লো ফুড পয়জনিং নয়
তো? কাকুর হোমিওপ্যাথির ওষুধের বাক্স থেকে এখনই ওষুধ খেতে হবে
আমাকে। তাই খেয়ে গিয়ে আবার বসেছি।
তখন আবার একটু পরেই আমার
মনে হ’লো বাথরুমে মানে টয়লেটে মানে এই গ্রামের ভাষায় মাঠে যেতে
হবে। এই রাতে একলাটি। কি করি? কাকু তো সবে ঘুমিয়েছে। ডাকা ঠিক
নয়। আর এখুনি মনে হয় কেউ আসছে ও না, বেশী রাত না হ’লে। অবশ্য গ্রামে
রাত সাড়ে দশটা অনেক রাত।
আমার পিন পিস্তল, একটা তোয়ালে,
একলোটা জল আর টর্চ নিয়ে কুয়োতলা ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলুম বাইরের দিকের
গেট না খুলে। খুব গাছপালা আছে এমন একটা জায়গা মিললো। তোয়ালে জড়িয়ে
বসে পড়ে বুঝলুম আমার পেট ছেড়ে দিয়েছে আর খুব কনকন ও করছে। নাঃ,
মার্ক সল-- ৩০ ও খেতে হবে দেখছি। নির্ঘাৎ ডালে কিছু মিশিয়ে দিয়েছে
কেউ। এ’তো খুব বিপদজনক জায়গা দেখছি। কারো ভরসা নেই। কাল স্রেফ
চিঁড়ে ভিজিয়ে তাই খেয়ে থাকব আমি। কাকু চিঁড়ে, মিল্ক পাউডার সব
সঙ্গে করে এনেছে।
গেন্জী জাঙিয়া পরে নিয়ে সেই
ওষুধ ও খেলুম আবার ঘরে ফিরে এসে। দরওয়ানের তখন ও পাত্তা নেই কোথাও।
কি আর করি একলাটি? আবার নিজের
জায়গায় গিয়ে বসলুম আমি।
কতক্ষন বসে ছিলুম তা জানি
না। হাতে তো ঘড়ি নেই আমার। একটা ডিজিটাল ঘড়ি না হলেই নয় দেখছি।
তা একটু বেশ ঝিমমতন এসে গিয়েছিলো আমার। শুকনো পাতার ওপরে মচ মচ
শব্দে চটকা ভাঙলো। পাতাগুলো আমিই এনে দাওয়ায় ছড়িয়ে রেখেছিলাম খানিক
আগে।
দেখি যে একটা লোক খুব সতর্কভাবে
দাওয়ায় এসে উঠে ঘরের দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সে প্রথমে শিকলটা
তুলে দরজা বন্ধ করতে চেষ্টা করলো । না পেরে তখন একটা পকেট স্প্রেগান
বার করে দরজায় আর জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে কি যেন স্প্রে করতে শুরু
করলো সিঁ সিঁ সিঁ করে। তারপরে সে স্প্রেগানটা পকেটে রেখে আর একটা
কি বার করল দেখে আমিও আমার পিন পিস্তলটা তুলে নিয়ে লোকটার পায়ে
নিশানা করলুম।
হঠাৎ ফস করে সে লাইটার জ্বেলে
ঘরের দরজা জানলায় আগুন ধরিয়ে দিলো। আমিও ট্রিগার টিপলুম। কাকুর
তৈরী আমার এই খেলনা পিস্তলের স্প্রিংটা খুব মজবুত আমি জানি। একবার
পায়ে পিন গেঁথে গেলে অপারেশান না করলে সে বার করা যাবে না তা ও
জানি।
‘আইরে বাপ্পা রে। মর গইলি রে…’ বলে সে চিৎকার করে পেল্লায় এক লাফ
দিয়ে নীচে গিয়ে পড়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে পালিয়ে গেল।
ও’দিকে ঘরের দরজা জানলা সব
দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে দেখে আমি পিস্তল ফেলে দিয়ে জলভর্তি লোটা
হাতে নিয়ে জল ছুঁড়ে আগুন নেভাতে উঠেপড়ে লেগে পড়েছি। অপরাধী ধরতে
চেষ্টা করবার তখন সময়ই নেই।
দরজার আগুন তো কিছুক্ষন পরে
নিভলো কিন্তু জানলার পলিথিন সীটটা পেট্রোলে ভিজে ছিল বলে দাউ দাউ
করে পুরোই জ্বলে গেল। কিছুতেই নিভলো না। ঘরের মধ্যে কিন্তু আগুন
লাগলো না কিছুতে, এই যা রক্ষা।
কাকু ততক্ষনে ঘুম ভেঙ্গে
আগুনের বহর দেখে লাফিয়ে উঠে ঘুমন্ত চঞ্চলকে কোলে তুলে নিয়ে জলে
জলময় দাওয়ায় এসে দাঁড়িয়ে আমার কান্ড দেখছে অবাক হয়ে।
‘এ’সব কি কান্ড বাদল? তুমি
শোওনি?’
‘না কাকু। এ’সব হচ্ছে লঙ্কাকান্ড।
আমাদের ঠিক গাধা বাঙালী মনে করে এরা।
আর ও কিছু কান্ড হয়েছে, কাকু। মনে হয় বার কয়েক করে আমাদের সকালে
উঠেই মাঠে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। তোমাকে ও আর চঞ্চলকে ও। আমার নম্বর
তো লেগেই গিয়েছে। হিঃ….হিঃ…হিঃ…’
‘কাকু, তুমি চঞ্চলকে নিয়ে
ঘরে চলো আমি বলছি সব’। …..
তাড়াতাড়ি করে কাকু কি সব
ট্যাবলেট ওষুধ বার করতে বসলো আমার সব কথা শুনে। তা সেই ওষুধ খেয়ে
ও আমাদের বার তিনেক করে দৌড়তেই হ’লো মাঠে তারপরে।
তাই পরের দিন আমাদের চিড়ে সম্বল করেই থাকতে হ’লো সত্যিই।
…………………………………………………..৩……………………………………………………..
দিনভোর গোটা এলাকাটা ঘুরলো
কাকু। বিকেলে দক্ষিনদিকটা দেখা বাকি আছে বলে সেইদিকে চললো পায়ে
হেঁটে। তা সে’দিকে চামারদের বস্তি ছাড়া আর কিছুই নেই দেখা গেল।
খাঁ খাঁ করছে মাঠ। দূরে গোটা কয়েক গাছ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বস্তির মধ্যে একটা মোটে গাছ ছিল। বহু পুরণো, তা সেটাকেও জন চারেক
লোক মিলে দড়ি দড়া বেঁধে কাটছে দেখে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
গ্রামেতেও দেখি শহরের হাওয়া লেগেছে। গাছ কেটে ঘর বাড়ী তোলা শুরু
হয়েছে।
আমরা দাঁড়িয়ে গাছ কাটা দেখছি।
মাথার ওপরে তিন চারটে কি
পাখি যেন খুব জোরে জোরে ডেকে ঘুরে ঘুরে উড়ছে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
হঠাৎ গাছটা মড় মড় করে উঠলো।
আর যারা গাছ কাটছিল, তারা গাছকাটা বন্ধ করে লাফিয়ে উঠে সরে গেল
পেছন দিকে। সরে গিয়ে তারা সবাই একসাথে মিলে সেই দড়িদড়া টেনে ধরলো।
গাছটা মড় মড় করে আড় হয়ে নীচু হচ্ছে তখন ধীরে ধীরে। কাকু সরে এলো
আমাদের নিয়ে কিন্তু চঞ্চল হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে ছুটে গেল সেই পড়ন্ত
গাছটার দিকে।
কি দুষ্টু ছেলেরে বাবা? ভয়
ডর বলে কিছুই নেই। বাধ্য হয়ে সঙ্গে সঙ্গে কাকু ও ছুটলো দুষ্টু
ছেলেটার পেছনে। বললো –‘এই চঞ্চল, না… না যেও না ও’দিকে এখন। গাছ
পড়ছে তো, সাবধান…’।
চঞ্চল খানিক এগিয়ে গিয়েই
হাই জাম্প দিলো একটা । ছেলেটা যখন নীচে এলো ধপ করে তখন তার দুধসাদা
হাতের গোলাপী করতলে কিছু রয়েছে দেখে কাকু বললো-‘ওটা আবার কি চঞ্চল?’
‘পাখির বাসা, কাকু। দু’টো
ছোট্ট ছোট্ট সাদামতন ডিম ও আছে এর ভেতরে। আমি দেখে নিয়েছি। এইজন্যেই
তো ওই পাখিরা অতো কাঁদছিলো, কাকু। তুমি শুনলে না এসেই …’
‘কি হবে ওই পাখির বাসা দিয়ে এখন?’
‘দূরের ওই গাছগুলোর একটার
ডালেতে তুলে বসিয়ে দেব। বাদল তো এক্সপার্ট ছেলে। ওর পকেটে সুতলি
ও আছে। আমি ঠিক জানি। বাসাটাকে দু’মিনিটেই ও ঠিক করে গাছে বসিয়ে
দেবে ডিম গুলোকে না ছুঁয়েই। জানো, কাকু। আমি অবশ্য পারবো না হিঃ…হিঃ…হিঃ….’
আবার সেই নেই কাজ তো খই ভাজ
অবস্থা আমার কপালে।
পরীর দেশের রাজকুমার অতি সুন্দর ছেলে চঞ্চলের আব্দার। না মেনে
আমি যাই কোথায়?’
যে গাছের ডালে বাসাটা বসিয়ে দিলুম আমি সেই গাছেই গিয়ে দেখি পাখিগুলো
ও বসে পড়লো সব ঝুপ ঝাপ করে। চেঁচামেচি সব তখন তাদের একদম বন্ধ।
কাকু অবশ্য বাসাটা নিচে থেকে আমার হাতে তুলে দিয়ে ছিলো সাবধানে,
নইলে একলা পারতুম না আমি তা ঠিক।
গাছটা থেকে নেমে এসে আমি
বললুম-‘এ’বার কি হুকুম, চঞ্চল?’
‘চল সোজা এগিয়ে গিয়ে, দেখি
ও’দিকটায় কি আছে?’
‘ভূত আছে…’
‘তাই দেখবো, চল’।
তাই চললুম তিনজনে। খানিকপথ
গিয়ে দেখি কিছু কোথাও নেই। নির্জন প্রান্তরে দূরে সূর্যাস্ত হচ্ছে।
খুব সুন্দর দৃশ্য। পিছন থেকে একটা পাখি এসে আবার উড়ছে ঠিক আমাদের
মাথার ওপরে।
‘ওই বাঁধমতন জায়গাটা কিসের
বল তো বাদল? ওইটার ওপরে উঠবো চল,বাদল। সূর্যাস্ত সুন্দর দেখা যাবে’।
আমি তাই গেলুম।
চঞ্চল আগে গিয়ে লাফিয়ে উঠলো
হাত চারেকের মতন উঁচু সেই মাটির বাঁধে।
আমি নীচে দাঁড়িয়ে ভাবছি যে মাঠের মাঝে এই লম্বামতন বাঁধটা কিসের?
ভেতরে ইট আছে হয়তো। তা এ’টা কোনকাজেই বা লাগে?
‘ওপারে কি আছে, চঞ্চল?’ আমি
জিজ্ঞাসা করলুম।
‘কিচ্ছু তো নেই বাদল। শুধু
বালির সমুদ্র। ওরে বাপরে….আরে আরে ঠোক্কর মারছিস কেন আমাকে। আমি
কি দোষ করলুম আবার?’।
বলেই ধপ করে নীচে আমার পাশে
লাফিয়ে নেমে এলো, চঞ্চল।
‘কি হয়েছে, চঞ্চল?’
‘আরে, ওই দুষ্টু পাখিটা না
আমাকে ঠুকরে তাড়িয়ে দিলো। সূর্যাস্ত দেখতে ও দেবে না ও আমাকে।
কি পাজী পাখি রে বাবা? আমি আবার উঠছি গিয়ে’।
চঞ্চল উঠেই কিন্তু আবার পরক্ষনেই
লাফিয়ে নেমে এলো সেই পাখিটার ঠোকর খেয়ে।
দারুণ রাগ করে চঞ্চল বললো—‘আমার
না বেজায় রাগ হচ্ছে, বাদল। তোর পিন পিস্তলটা একবার আমাকে দে তো,
আমাকে ঠোকর মারা বার করে দিচ্ছি। দুষ্টু পাখিটার দু’টো ঠোঁটই না
পিন দিয়ে গেঁথে বন্ধ করে দিয়েছি তো আমার নাম চঞ্চল নয়’।
আমি ভ্রু কুঁচকে বললুম –‘একদম
না চঞ্চল। আর কাকু, তুমি এই দুষ্টু ছেলেটাকে কোলে তুলে নাও তো।
একদম ছাড়বে না কিন্তু। আমার মনে হচ্ছে কিছু বিপদ আছে এই জায়গাটায়।
ওই পাখিটা সব জানে। আমরা কিচ্ছুটি জানি না। আমি পরীক্ষা করবো।
এখুনি আসছি…’
কাকু চঞ্চলকে তখনি নীচু হয়ে
কোলে তুলে নিলো আর পাখিটা ও তাই না দেখে ফিরে চলে গেল সেই গাছটায়।
এ’ কি রহস্য রে বাবা?
আমি যখন ফিরে এলুম তখন আমার
হাতে সেই কাটা গাছটার একটা ছোট ডাল দেখে চঞ্চল বললো-‘গাছের ডাল
দিয়ে পাখি তাড়াবি না কী, বাদল?’
আমি উত্তর না দিয়ে ডালটা
নিজের শার্টের মধ্যে গুঁজে নিয়ে সেই বাঁধটার ওপরে চঞ্চলের মতন
লাফিয়ে না উঠে দু’পায়ে ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দু’হাতের চাপে আস্তে করে
উঠে পড়লুম ।
আমার দেখাদেখি কাকু ও চঞ্চলকে
নামিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে বলে নিজে ও উঠে পড়ল
বাঁধটায়। চঞ্চল দুষ্টু ছেলে হ’লে কি হয়, ও ভীষণ বুদ্ধিমান আর কাকুর
দারুণ বাধ্য ছেলে। ঠিক শ্বেতপাথরের মূর্ত্তির মতন রূপবান ছেলেটা
দাঁড়িয়ে রইলো।
আমি ডালটা হাতে নিয়ে বাঁধের
ও’পারে বালিতে ছুঁড়ে দিয়ে বুকে ভর দিয়ে শুয়ে রইলুম বাঁধের ওপরে।
কাকুও। তবে কাকু বার বার মুখ ফিরিয়ে চঞ্চল কি করছে তাও দেখে নিচ্ছিলো।
প্রথমে কিছুক্ষন তো কিছুই
হ’লো না। ডালটা বালিতে পড়েই ছিলো। তারপরে ধীরে ধীরে সেটা সোজা
হয়ে উঠতে শুরু করলো আপনিই। ঠিক যেন ভৌতিক কান্ড।
ভারী দিকটা নীচু হয়ে বালিতে গেঁথে গেল। একটু পরেই গোড়ার দিকটা
ডুবে গেলো আর তারপরে গোটা ডালটাও খুব ধীরে ধীরে বালিতে তলিয়ে যেতে
শুরু করলো।
ব্যাপার দেখে কাকু বললো-‘বাদল,
তোমার কি মহাভারতের যুদ্ধের গল্পের কথা মনে আছে? মহারথী কর্ণের
রথচক্র দিনের শেষে মেদিনী গ্রাস করে ছিলো জানো তো? কুরুক্ষেত্রের
বিশাল প্রান্তরের কোন ও এক অংশের মতন এও হচ্ছে সেই সর্বগ্রাসী
মেদিনী। আসলে কোন নদী বা জলাশয়ের বহু পুরনো খাত। এখন সেই নদী লুপ্ত
বা অন্তঃসলিলা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বালির নীচে এখন ও শক্ত মাটি
নেই, হয়তো পাঁক কাদা বা জল আছে। তাই ওপরের বালি ও শক্ত নয়, চলায়মান।
এই হচ্ছে সেই প্রাচীন নদীর …’
আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে ফেললুম-‘বাঁধ
বা তটবন্ধ, কাকু। যাকে ওরা হিন্দীতে তটবন বলছিলো। আর আমাকে এই
বালিতেই ফেলে দেবে বলছিলো তুমি এই জায়গায় যদি আসো, ওদের বারণ না
শুনে। আমাকে তাই অপহরণ করেছিলো বাড়িতে কখন আমি একলা আছি তা জেনে
নিয়ে। এই তবে চোরাবালি, কাকু?’
‘একদম ঠিক, বাদল। এখন আমি
বুঝে গেছি রহস্যটা কোথায়। বাদল তুমি নেমে যাও। আমি শুয়ে শুয়ে আর
বুকে হেঁটে পুরো বাঁধটা এখুনি পরীক্ষা করতে চাই। তুমি পিস্তলটা
নাও আমার। রেডী থাকবে। কোন কিছু এগিয়ে আসছে বা নড়ছে দেখলেই গুলি
চালাবে। নো মার্সি। কুইক’।
আমি নেমে পড়লুম নীচে আর কাকু
নিজের ডান হাতটা বাঁধের ভেতর দিকে ঝুলিয়ে রেখে বাঁ হাতে ভর দিয়ে
দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগলো বাঁধের ওপরে শুয়েই। কাজটা খুব কঠিন। হাতে
ভীষণ জোর লাগে। একটুতেই হাঁফিয়ে যেতে হয়। কাকু থেমে থেমে এগিয়ে
চললো। সাথে নীচে আমরা ও।
অনেকক্ষন পরে ঘোর অন্ধকার
হয়ে আসতে কাকু নেমে এসে মাটিতেই শুয়ে পড়ে বললো-‘বাদল, চঞ্চলকে
বলো, ওর বাপিকে ফোন করতে। যেন এখুনি কপ্টারে চলে আসে’ ।
একটু থেমে শ্বাস নিয়ে কাকু
আবার বললো—‘ততক্ষণ আমাদের এইখানেই থাকতে হবে পাহারায়, প্রাণের
ঝুঁকি নিয়ে। এখন ও হয়তো ফোর্স আসে নি। তবে আমি রহস্যের সন্ধান
পেয়ে গেছি। এই বাঁধের নীচের দিকে ঠিক এইখানে একটা লোহার বোল্ট
পোঁতা আছে । আর সেই বোল্টে বাঁধা আছে একটা সরু কালো মজবুত নাইলন
কর্ড। দড়িটা অনেক লম্বা। সব কিছুই বালিতে ডুবে আছে আর সেই দড়ির
অপরপ্রান্তে খুবই ভারী কিছু বাঁধা আছে। টেনে তোলা একলার সাধ্য
নয়’।
চঞ্চল ফোন করলো।
চঞ্চলের বাপী ফোন তুলেই রাগ
করে বললেন—‘আরে, আমি তো এসেই পড়েছি। যতদূর পেরেছি কপ্টারে আসবার
পরে এখন পুলিশের অয়্যারলেস ভ্যানে আসছি। তুই কাকুর সঙ্গে নৌগড়
গিয়েছিস শুনেই তোর মা আমাকে ফোনে তাড়া করতে শুধু বাকি রেখেছে।
বাদল ছেলেটা তো হচ্ছে মাস্টার বন্ড, ওকে তো যেতেই হবে, তাই গেছে।
তোর খামোকা ওই সব ডেন্জারাস জায়গাতে যাবার কি দরকার ছিল, শুনি?’
‘আমি তোকে কিন্তু ধরে এমন
পিট্টি দেব যে তখন বুঝবি। তা নৌগড় বাজার আসছে। সে’খান থেকে তোরা
যেখানে আছিস সেইখানে যাবার রাস্তা বল। নাঃ, সে ও তোর দ্বারা হ’লে
তো। ফোনটা তোর কাকুকে দে শীগ্গির করে দেখি…’।
তারপরে তো কিছুক্ষনের মধ্যেই
পুলিশ নিয়ে ভ্যান এসে হাজির।
তখন কাকু সব চোরাই মাল উদ্ধার
করতে শুরু করলো।
একটা নয় চারটে বোল্টে বাঁধা
বিরাট বিরাট সব বান্ডিল টেনে তোলা হ’লো। সোনার বিষ্ণু মূর্ত্তির
সাথে অনেক অনেক অন্য সব ঠাকুরের মূর্ত্তি আর গয়না পত্র টাকা পয়সা
বহু কিছু দামী জিনিষ উদ্ধার করা হ’লো। পুলিশ সতর্ক ছিলো বলে চোরেরা
সব চুরি বা ডাকাতী করে নিয়ে এসে ও কিছুই বিক্রী করে উঠতে পারে
নি।
তবে আমার কিন্তু মনে হয় যে
এইবার আর চোর ডাকাতগুলোর কোন নিস্তার নেই,
তা ঠিক। বিশেষ করে চঞ্চল সমেত সবাইকে পুড়িয়ে মারবার অপচেষ্টার
কথা শুনে চঞ্চলের পুলিশ অফিসার বাপী যা রাগবে না।
এখন ও তো সে’কথা কিছু জানেই না …হিঃ হিঃ হিঃ …
কাকু, কিন্তু তখন সেই সমস্ত
জিনিষপত্র পুলিশের জিম্মাতে দিয়ে আমাদের দু’জনের হাত ধরে নিয়ে
ছুটলো বাড়ী মানে বাসার পথে।
আমাদের গায়ের গরম আর ধূলো
ময়লা কাটাতে আগে তিনজনে করলুম সেই কূয়োর মিষ্টি ঠান্ডা জলে চান
তারপরে চিঁড়ে টিঁড়ে যা ছিলো জলে ভিজিয়ে পেট পুরে খেয়ে নিলুম।
আর তারপরেই কাকু জিনিষপত্র
সব গুছিয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠে পডলো। সেই ঘরে আর থাকে কাকু চঞ্চলকে
নিয়ে?
আমি কিন্তু গাড়ির পিছনের
সীটে শুয়ে একটু পরেই একদম ঘুমিয়ে গেলাম। চঞ্চল ও ঘুমিয়ে পড়েছিলো
আমার পাশেই শুয়ে, খানিক পরে। কিন্তু কাকু ঠায় জেগে বসে ছিল।
সকাল হয়ে যাবার পরে আমার
ঘুম ভাঙতে উঠে দেখি ততক্ষনে আমরা কাশীর গঙ্গার ব্রিজ পার হয়ে এসেছি।
তার মানে বাড়ী তো এসেই গেছে।
আর কি?
জি০সি০ভট্টাচার্য,
বারাণসী, উত্তর প্রদেশ।